বেইরুট: শত্রুপক্ষকে নিকেশ করার ক্ষেত্রে তাদের জুড়ি নেই। আবারও খবরের শিরোনামে ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা Mossad. লেবাননে একসঙ্গে ৩০০০ পেজার বিস্ফোরণের জন্য তাদের দিকেই আঙুল উঠছে। ইজরায়েল বনাম হামাস যুদ্ধে লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হেজবোল্লা সরাসরি ইজরায়েলের বিরোধিতা করেছে। এমনকি দু'পক্ষের মধ্যে ড্রোন, রকেট হামলাও চলেছে বেশ কয়েক বার। সেই হেজবোল্লাকে নিকেশ করতেই Mossad পরিকল্পিত ভাবে একসঙ্গে ৩০০০ পেজারে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ। (Lebanon Pager Explosions)
ইজরায়েল বনাম হামাস যুদ্ধে হেজবোল্লাও জড়িয়ে পড়েছে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে। ইজরায়েলি গোয়েন্দাদের নজরদারি এড়াতে বেশ কয়েক মাস আগেই মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধ করে দেয় তারা। কেউ যাতে লোকেশন ধরতে না পারে, তার জন্যই মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই থেকে তাদের কথোপকথনের মাধ্যম হয়ে ওঠে পেজার, যার মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত লিখিত বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু Mossad-এর হাতে সেই পেজারই মানুষ মারার অস্ত্র হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ। আমেরিকা জানিয়েছে, এই ঘটনায় তাদের কোনও যোগ নেই। যদিও সপ্তাহ দুয়েক আগেই আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ বেইরুট মেডিক্যাল সেন্টারে কর্মরত চিকিৎসক এবং কর্মীদের ব্যবহৃত পেজার পাল্টে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ সামেন এসেছে। (Isarel-Hezbollah Conflict)
এখনও পর্যন্ত মঙ্গলবারের এই পেজার বিস্ফোরণে শিশু-সহ ন'জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। আহত হয়েছেন প্রায় ৩০০০ মানুষ। লেবাননে ইজরায়েলের রাষ্ট্রদূতও আহত হয়েছেন হামলায়। আহতদের মধ্যে ২০০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। কিন্তু একসঙ্গে ৩০০০ পেজারে বিস্ফোরণ ঘটানো হল কী করে, প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। এর নেপথ্যে 'জটিল অপারেশন' রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বেশ কয়েক মাস আগে তাইওয়ানের সংস্থা Gold Apollo-কে ৫০০০ পেজারের বরাত দেয় হেজবোল্লা। সেই পেজারগুলিতেই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। যদিও তাইওয়ানের ওই সংস্থার দাবি, তারা পেজারগুলি তৈরি করেনি, তার মধ্যে বিস্ফোরক থাকার ব্যাপারেও কিছু জানা নেই তাদের। বরং ইউরোপের BAC সংস্থাই পেজারগুলি তৈরি এবং বিক্রি করে। শুধুমাত্র তাদের সংস্থার লোগো ব্যবহৃত হয়েছিল।
এই ঘটনায় হেজবোল্লার নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স, তাতে একাধিক দাবি উঠে এসেছে। জানা গিয়েছে, চলতি বছরের শুরুতেই তাইওয়ানের ওই সংস্থার কাছ থেকে ৫০০০ AP924 মডেলের পেজার এসে পৌঁছয়। সেই থেকে পেজারগুলি ব্যবহার করছিলেন হেজবোল্লার সদস্যরা। কিন্তু তার ভিতরে যে ইজরায়েল চিপ বসিয়ে রেখেছে, তা টের পাননি কেউ।
হেজবোল্লার একটি সূত্রের দাবি, তাদের হাতে আসার আগে Mossad পেজারের নকশা পাল্টে দেয়। পেজারের ভিতর সূক্ষ্ম একটি চিপ বসিয়ে দেওয়া হয়, যার মধ্যে তিন গ্রাম বিস্ফোরক পদার্থ রেখে দেওয়া হয়। এত সূক্ষ্ম ওই চিপ যে কোনও স্ক্যানারেই সেটি ধরা পড়েনি। পেজারের ব্যাটারিতে PETN বিস্ফোরক রেখে দেওয়া হয় বলে জানা যাচ্ছে। ওই চিপ থেকে Mossad-এর কাছে সঙ্কেত পৌঁছে যেত। মঙ্গলবারও তেমনই সঙ্কেত পৌঁছে যায়। এর পর ব্যাটারির তাপমাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে যায় এবং তা থেকে বিস্ফোরণ ঘটে। এর পরই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ৩০০০ পেজারে একসঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে।
নাশকতার কাজে ব্যবহৃত PETN এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী বিস্ফোরক। তার রিলেটিফ এফেক্টিভনেস ফ্য়াক্টর ১.৬৬, TNT-র চেয়েও বেশি। PETN তুলনামূলক ভাবে স্থিতিশীল। ঘর্ষণ বা ধাক্কায় তেমন কিছু হয় না। কিন্তু উচ্চ তাপমাত্রায় বিস্ফোরণ ঘটে, যা থেকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। এখনও পর্যন্ত এত বড় হামলার মুখে তাদের পড়তে হয়নি বলে দাবি হেজবোল্লার। আমেরিকার Wall Strett Journal জানিয়েছে, পেজার গরম হতে দেখে হেজবোল্লার অনেকে ফেলে দিয়েছিলেন। তাঁরা রক্ষা পেয়েছেন। Al Jazeera লেবাননের নিরাপত্তা বিভাগের একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, পেজারে যে বিস্ফোরক বসানো হয়, তার ওজন ছিল ২০ গ্রামের কম। সঙ্কেতের মাধ্যমে দূরে বসে কী করে ব্যাটারি গরম করে তোলা হল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
লেবাননে ইজরায়েলের হামলায় ১৭০ জন হেজবোল্লা সদস্য ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছেন। এই আবহে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন ঘটায় হেজবোল্লা। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হাসান নাসরাল্লা বিবৃতি দিয়ে সমর্থকদের সতর্ক করেন। ইজরায়েলি গুপ্তচরদের চেয়ে মোবাইল ফোন অনেক বেশি বিপজ্জনক বলে জানান তিনি। ফোন ভেঙে মাটিতে পুঁতে দিতে, বাক্সে পুরে তালা দিতে আহ্বান জানান হাসান। এর পরই পেজারের ব্যবহার শুরু করে হেজবোল্লা। কিন্তু সেই পেজারই Mossad-এর হাতে মানুষ মারার অস্ত্র হয়ে উঠেছে বলে দাবি তাদের। সিরিয়াতেও এমন পেজার বিস্ফোরণ ঘটেছে। একটি গাড়ি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেখানে।
এই যদিও প্রথম বার নয়। লেবাননে পেজার বিস্ফোরণ নিয়ে এখনও পর্যন্ত কিছু না বললেওস, শত্রুপক্ষকে নিকেশ করতে আগেও এমন ঘটনা ঘটানোর অভিযোগ উঠেছে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে। আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের এক প্রাক্তন বিশেষজ্ঞ জানান, ১৯৯৬ সালে হামাস নেতা ইয়াহিয়া আয়াশকে খুন করতে ফোনের মধ্যে ১৫ গ্রাম RDX ঢুকিয়ে দিয়েছিল Mossad. ইয়াহিয়া বাবাকে ফোন করতে যেতেই বিস্ফোরণ ঘটে এবং মারা যান ইয়াহিয়া। ইজরায়েলের আর এক গুপ্তচর সংস্থা Shin Bet সেই ঘটনায় যুক্ত ছিল বলে জানা যায়।