সঞ্চয়ন মিত্র, কলকাতা: আজ শিবরাত্রি। ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে শিবরাত্রি ব্রত পালন করা হয়। গৃহীরা যেমন শিবের পুজো করেন তেমনি সন্ন্যাসীদের কাছেও শিবরাত্রি একটা মহোৎসব। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে পার্বতী একবার শিবের কাছে জানতে চান কোন ব্রত পালনে শিব সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন। তার উত্তরে শিব ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণচতুর্দশী তিথির উল্লেখ করেন। কিন্তু এত দিন থাকতে ঐ দিনটাই এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?


ভবিষ্য পুরাণ থেকে জানা যায় একসময় বারাণসীতে এক ব্যাধ ছিলেন। পশুপাখি বধ করে তার জীবিকা নির্বাহ হত। একদিন শিকার করতে করতে জঙ্গলের মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসে। ঘন অন্ধকারে মনের মধ্যে ভয় পেয়ে এক বেল গাছের ওপরে সে আশ্রয় নেয়। সেদিন ছিল ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণচতুর্দশী তিথি। এদিকে ভোরবেলা শিকারে বেরিয়ে কিছুই খাওয়া হয়নি ব্যাধের। রাতে গাছের উপর শুয়ে যখন সে নড়াচড়া করছে তখন গাছ থেকে কিছু বেল পাতা এবং তার শরীরের ঘাম ঝরে পড়ে ওই গাছেরই নিচে থাকা শিবলিঙ্গের ওপর। এভাবে অজান্তেই সে শিবকে তুষ্ট করে সিদ্ধিলাভ করে। এদিকে রাত কেটে ভোর হয়। বাড়িতে ফিরে সে পরিবারের লোকেদের আশ্বস্ত করে। বাড়িতে এসে খেতে যাবে এমন সময় এক অতিথি দ্বারে এসে ভিক্ষা চাইলে সে তার নিজের খাবার সেদিন দিয়ে দেয়। এতে তাঁর পারণের ফল লাভ হয়। এর কিছুদিনের মধ্যে ব্যাধের মৃত্যু হলে যমদূতেরা তাকে নিতে এসে দেখে আগে থেকেই সেখানে শিব দূতেরা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু মৃত্যুর পর সবাইকেই যমালয়ে যেতে হয়। এর অন্যথা হবে না। তাই যমদূতরা ফিরে গিয়ে যমরাজকে নালিশ জানায়। এবার স্বয়ং যমরাজ এসে উপস্থিত হন। তিনি এসে দেখেন স্বয়ং শিবের অনুচর নন্দী সেখানে উপস্থিত। নন্দীর মুখে ব্যাধের শিব পুজোর কথা শুনে ফিরে যান যমরাজ। আর ব্যাধের স্থান হয় শিবলোকে। সেই থেকে শিবরাত্রি এবং শিব পুজোর মহিমা যুগে যুগে ছড়িয়ে পড়ে।




একশ্রেণির পন্ডিত মনে করেন শিব হলেন অনার্য দেবতা। দক্ষযজ্ঞ করে তিনি আর্য সমাজে স্থায়ী আসন করে নেন। আবার বেদে দেবতা হিসেবে শিবের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে সেখানে রুদ্র নামের উল্লেখ রয়েছে। পন্ডিতদের মতে বৈদিক রুদ্র এবং পৌরাণিক শিব আসলে অভিন্ন। শিব কৈলাসবাসী হলেও ভারতের উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্রই শৈবতীর্থ বর্তমান। যেমন ভারতের নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে শিবের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ তেমনি হিমালয় তীর্থে বিরাজমান পঞ্চকেদার। এর পিছনে অবশ্য মহাভারতের একটা গল্প রয়েছে।


কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরব এবং পাণ্ডব দুপক্ষেরই বহু আত্মীয় নিধন হয়। সেই পাপ থেকে উদ্ধার পেতে হিমালয় গিয়ে শিবের তপস্যা করতে থাকেন পাণ্ডবরা। কিন্তু শিব কিছুতেই তাদের ধরা দেন না। একবার শিব যখন মহিষের রূপ ধরে পালাচ্ছেন তখন ভীম পিছন থেকে তাঁকে জাপটে ধরে। সেই জায়গায় গড়ে ওঠে কেদারনাথ। কেদারনাথের মূল বিগ্রহ তাই মহিষের পিঠের আকৃতি। এরপর একে একে তুঙ্গনাথে বাহু, মদমহেশ্বরে নাভি, রুদ্রনাথে মুখ এবং কল্পেশ্বরে জটা দেখা যায়। কেদারনাথ সহ এই পাঁচটি জায়গা পঞ্চকেদার নামে পরিচিত।


শিবরাত্রি আসলে সন্ধে থেকে ভোর পর্যন্ত রাতের চার প্রহরের পুজো। প্রত্যেক প্রহরে আলাদা আলাদা জিনিস দিয়ে শিবের স্নান করানো হয় এবং আলাদা আলাদা মন্ত্রের সঙ্গে অর্ঘ্য প্রদান করা হয়।


শিবরাত্রির প্রথম প্রহরে শিবকে দুধ দিয়ে স্নান করানো হয়। যার মন্ত্র-


‘ইদং স্নানীয়দুগ্ধং ওঁ হৌঁ ঈশানায় নম:’


দ্বিতীয় প্রহরে দই দিয়ে শিবকে স্নান করানো হয়। যার মন্ত্র-


‘ইদং স্নানীয়ং দধি ওঁ হৌঁ অঘোরায় নম:’


তৃতীয় প্রহরে শিব কে ঘি দিয়ে স্নান করানো হয়। যার মন্ত্র-


 ‘ইদং স্নানীয়ং ঘৃতং ওঁ হৌঁ বামদেবায় নম:’


চতুর্থ প্রহরে মধু দিয়ে স্নান করানো হয়। যার মন্ত্র-


 ‘ইদং স্নানীয়ং মধু ওঁ হৌঁ সদ্যোজাতায় নম:’


চার প্রহরের পুজো শেষে শিবমহিম্ন স্তোত্র পাঠ বিধেয়।