নয়াদিল্লি: অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে জলঘোলা হয়েছিল। পরে আমন্ত্রণপত্র গেলেও, ২২ জানুয়ারি অযোধ্যার অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি লালকৃষ্ণ আডবাণীকে (Lal Krishna Advani)। 'রাম জন্মভূমি আন্দোলনের' অন্যতম মুখ আডবাণীকে মন্দির উদ্বোধনে ব্রাত্য রাখা নিয়ে আক্রমণ শানিয়েছিলেন বিরোধীরাও। তার পর দু'সপ্তাহও কাটল না, ৯৬ বছর বয়সি আডবাণীকে 'ভারতরত্ন' সম্মান প্রদানের ঘোষণা করল কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) সরকার। রামমন্দিরের উদ্বোধন এবং আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে ধরলে আডবাণীকে দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মানপ্রদানের নেপথ্যে বিজেপি-র রাজনৈতিক কৌশল রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহলের একাংশ।


আডবাণীকে 'ভারতরত্ন' সম্মানে ভূষিত করা হবে বলে শনিবার ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। নিজে ফোন করে আডবাণীকে তিনি অভিনন্দন জানিয়েছেন বলেও জানান। মোদির এই ঘোষণাই এই মুহূর্তে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। কারণ মোদি এবং আডবাণীর সম্পর্কের জটিলতার কথা কারও অজানা নয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ম সেবক সঙ্ঘ থেকে তরুণ মোদিকে BJP-তে আডবাণীই জায়গা করে দেন। সেখান থেকে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে উন্নীত হন মোদি। ২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার পর অটলবিহারি বাজপেয়ী যখন সর্বসমক্ষে মোদিকে 'রাজধর্ম' পালনের নির্দেশ দেন, সেই সময়ও আডবাণীই ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন বলে শোনা যায়। 


কিন্তু ২০১২ সাল থেকে মোদি এবং আডবাণীর বোঝাপড়ায় চিড় ধরে। কারণ তখন থেকেই ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে BJP-র মুখ হিসেবে মোদির নাম নিয়ে চর্চা শুরু হয়। এতে আডবাণী অসন্তুষ্ট হন। মোদি এবং অমিত শাহ বিজেপি-র সর্বেসর্বা হয়ে ওঠাও আডবাণীর পছন্দ হয়নি বলেও জানা যায়। এর পর বিজেপি-র 'মার্গদর্শক মণ্ডলে' জায়গা হয় আডবাণীর, যা গেরুয়া শিবিরে 'অবসরকালীন জায়গা' হিসেবেই পরিচিত। সেই নিয়ে আডবাণী প্রকাশ্যে কিছু না বললেও,  আডবাণী-পন্থী বলে পরিচিত তদানীন্তন বিজেপি নেতা (অধুনা তৃণমূল) শত্রুঘ্ন সিন্হা সরব হয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, "যেভাবে পরিকল্পনা করে আডবাণীকে সরিয়ে দেওয়া হল, তা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক এবং লজ্জাজনক।"


আরও পড়ুন: LK Advani Bharat Ratna: ভারতরত্ন সম্মান পাচ্ছেন লালকৃষ্ণ আডবাণী


প্রকাশ্যে এ নিয়ে কোনও বিবৃতি না দিলেও, ২০১৫ সালে একটি অনুষ্ঠানে আডবাণীর বক্তব্য ছিল, "এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি, তাতে গণতন্ত্র গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম যে শক্তি, তারাই সংবিধান এবং আইনি নিরাপত্তার ঘেরাটোপে রয়েছে, আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।" ইন্দিরা গাঁধীর আমলে জারি হওয়া জরুরি অবস্থার উল্লেখ করে আডবাণীকে সেই সময় বলতে শোনা যায়, "আমি বলছি না যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভাবনা পরিণত নয়। কিন্তু কিছু খামতি রয়েছে।  আবারও জরুরি অবস্থা জারি হবে না, এমনটা জোর দিয়ে বলতে পারছি না আমি।বর্তমান দিনের রাজনীতিতে অসাধারণ নেতৃত্বের কোনও উদাহরণ আমি পাইনি। গণতন্ত্র এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত অন্য বিষয়গুলির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার অঙ্গীকারে খামতি রয়েছে।"


এর পর যত সময় এগিয়েছে, সক্রিয় রাজনীতি থেকে কার্যতই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন আডবাণী। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে সেই তিনিই এবার খবরের শিরোনামে উঠে এলেন। সবে রামমন্দিরের উদ্বোধন মিটেছে। অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটে দ্বিতীয় মোদি সরকারের কৃতিত্বের মধ্যেও রামমন্দিরের উল্লেখ উঠে এসেছে। আগামী নির্বাচনে রামমন্দিরকে সামনে রেখে বিজেপি যে ভোটবাক্স ভরতে চাইবে, অভিযোগ করছেন বিরোধীরাও। সেই আবহেই অযোধ্যায় রামমন্দিরের জিগির তোলা আডবাণীকে সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান প্রদান করে বিজেপি হিন্দুত্বের অস্ত্রে শান দিল বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ এবং বিরোধীরাও। 


তাই এদিন মোদির ঘোষণার পরই কটাক্ষ ছুড়ে দেন সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব। তাঁর কথায়, "আগেও বলেছি, আবারও বলছি, ওদের সাংসদদের সকলের টিকিট হাতছাড়া হচ্ছে এবার। সম্মানের জন্য এই সম্মান দেওয়া হচ্ছে না। ভোট ধরে রাখতে ভারতরত্ন সম্মান দেওয়া হচ্ছে।" বিজেপি-র একসময়ের শরিক শিবসেনা (উদ্ধবপন্থী) নেতা আনন্দ দুবে বলেন, "লালকৃষ্ণ আডবাণীজি ভারতরত্ন পাচ্ছেন বলে সবে জানতে পারলাম। বরাবর বিনম্র রাজনীতি করেছেন উনি। সকলকে একছাতার তলায় এনেছেন। হিন্দুত্বের ধ্বজা আরও উঁচু করে তুলে ধরেছেন উনি। কিন্তু বীর সাভারকর, বালাসাহেব ঠাকরে কবে ভারতরত্ন পাবেন? শুধু নির্বাচন এলেই কেন ভারতরত্ন দেওয়ার কথা মনে পড়ে এই সরকারের?"


বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ এই মুহূর্তে রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে 'ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা'য় রয়েছেন। ঝাড়খণ্ড থেকে তিনি বলেন, "২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদিকে বাঁচিয়েছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। ২০১৪ সালে গাঁধীনগরে আডবাণী বলেছিলেন, 'নরেন্দ্র মোদি আমার শিষ্য নয়, কিন্তু দক্ষ ইভেন্ট ম্যানেজার'। ওঁদের দেখলে এই দু'টি কথাই মনে পড়ে আমার। ২০১৪ সালে মোদির আসল চেহারা ২০১৪ সালে সকলের সামনে তুলে ধরেছিলেন।"


হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে শান দেওয়ার পাশাপাশি, তৃতীয় বার কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলে মরিয়া বিজেপি, দলের অন্দরে আডবাণীপন্থীদেরও মনজয়ে সচেষ্ট বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। কারণ নির্বাচনী রাজনীতিতে বিজেপি-কে প্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্ব আজও তাঁকেও দেওয়া হয়। তবে রাজনীতিতে যে উচ্চতায় পৌঁছনোর কথা ছিল, সেখানে আডবাণী পৌঁছতে পারেননি বলে মনে করেন গেরুয়া শিবিরের অনেকেও। এর নেপথ্যে আডবাণীর বিতর্কিত রাজনৈতিক জীবনকেও দায়ী করা হয়। 'রাম জন্মভূমি আন্দোলনে'র জেরে হিংসা, দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ থেকে ১৯৯১ সালে কাশ্মীরি জঙ্গিদের গ্রেফতারিতে হাওয়ালা-যোগে নাম জড়ানো, পাকিস্তানে গিয়ে মহম্মদ আলি জিন্নাহ্কে ধর্মনিরপেক্ষ নেতা ঘোষণা করায় দেশে ফিরে বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া বার বার বিতর্কে জড়িয়েছেন আডবাণী। তবে দলের অন্দরে তাঁর প্রতি সমব্যথী নেতার সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাই আডবাণীকে সম্মানপ্রদানের নেপথ্যে মোদি-শাহের বৃহত্তর স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে বলে মত রাজনৈতিক মহলের একাংশের।