কলকাতা: লোকাল ট্রেন হোক বা দূরপাল্লার, খরচ সাধ্যের মতো হওয়াতেই আজও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ভারতীয়দের প্রথম পছন্দ রেল। ‘বন্দেভারত’, বুলেট ট্রেনের জমানাতেও তাই ভাঁটা পড়ে না যাত্রী সংখ্যায়। কিন্তু ওড়িশার বালেশ্বরের দুর্ঘটনার পর সেই রেলযাত্রাই এখন বিভীষিকা হয়ে উঠেছে। শুক্রবার সন্ধে থেকে শনিবার সন্ধে পর্যন্ত মৃতের সংখ্য়া ৩০০ ছুঁইছুঁই (Odisha Train Accident)।


একসঙ্গে তিনটি ট্রেন কী করে দুর্ঘটনায় পড়ল, যে দুর্ঘটনা প্রতিরোধী যন্ত্র নিয়ে এত ঢক্কানিনাদ, ট্রেনে সেটি কেন ছিল না, এমন হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারকে (Coromandel Express Accident)।  বছর বছর রেকর্ড মুনাফা সত্ত্বেও রেলের তরফে এমন গাফিলতি কেন, উঠছে প্রশ্ন।  যদিও ২০১৬ সালেই সিঁদুরে মেঘ দেখতে পেয়েছিল বিশেষজ্ঞ মহল। কারণ ওই বছরই প্রথম পৃথক রেল বাজেটের রেওয়াজ তুলে দিয়ে, তাকে সাধারণ বাজেটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।  তাতে রেলের গুরুত্ব একধাক্কায় কমে গেল বলে সরব হয়েছিলেন বিজেপি বিরোধী শিবিরের অনেকেই (Merger of Rain Budget)।


ভারতীয় রেল ও রেল বাজেট


ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু দ্বীপ নিয়ে তৈরি নয় ভারত। পর্বত, সমতল মিলিয়ে বিস্তৃত ভূখণ্ড। তাই সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গেলে যে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, তা বুঝেছিল ইংরেজ শাসক। তাই ১৮৩১ সালে তৎকালীন মাদ্রাজে ভারতীয় রেল যোগাযোগ গড়ে তোলার প্রস্তাব জমা পড়ে। কিন্তু শুধু রেলপথ গড়ে তুললেই হল না, নিয়মিত তার রক্ষণাবেক্ষণও প্রয়োজন। তাই ১৯২৪ সাল থেকে পৃথক রেল বাজেটের ব্যবস্থাও হয়।


সেই রীতি চলে এসেছে স্বাধীনতা অর্জনের পরও। ২০১৬ সালেই তাতে ছেদ পড়ে। পৃথক রেল বাজেটের রেওয়াজ তুলে দেওয়ার সুপারিশপত্র জমা দেয় নীতি আয়োগ কমিশন। নীতি আয়োগের চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তৎকালীন  রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর কাছে ওই সুপারিশ জমা দেওয়া হয় নীতি আয়োগের তরফে। নীতি আয়োগের কাছ থেকে ওই সুপারিশপত্র পেয়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে চিঠি লেখেন প্রভু। পৃথক রেল বাজেট না রেখে, সেটিকে সাধারণ বাজেটের অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়।


আরও পড়ুন: Coromandel Express Accident: ট্রেন দুর্ঘটনার নেপথ্যে কি নাশকতা! তুঙ্গে জল্পনা, পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি তুললেন মমতা


পৃথক রেল বাজেটের অবসান


২০১৬ সালেই রাজ্যসভায় বিষয়টি উত্থাপিত করেন জেটলি। রেল বাজেটকে কেন্দ্রীয় বাজেটের অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। নীতি আয়োগের দাবি ছিল, সাধারণ বাজেটের চেয়ে রেলের খরচ ধারাবাহিক ভাবে কমে এসেছে। সড়ক এবং প্রতিরক্ষার বাজেট অনেক বেশি। তাই পৃথক ভাবে বাজেট রাখার প্রয়োজন নেই। নীতি আয়োগের দাবি ছিল, ১৯২৪ সালে তৎকালীন ইংরেজ সরকার পৃথক রেল বাজেট চালু করেছিল। কারণ সেই সময় দেশের অভ্য়ন্তরীণ উৎপাদন এবং রাজস্ব রেলের উপর নির্ভরশীল ছিল, যা থেকে লাভবান হতো ইংরেজ শাসক। এ বার ভারতের এই রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। এতে রেলকে আর ডিভিডেন্টও দিতে হবে না সরকারকে।


এর পর, ২০১৭ সালে প্রথম বার সাধারণ বাজেটের অন্তর্ভুক্ত করে রেল বাজেট পেশ করেন জেটলি। সেই থেকে একত্রে বাজেট পেশের রীতিই চলে আসছে। যদিও গোড়াতেই এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ এবং বিজেপি বিরোধী শিবিরের একাংশ। প্রাক্তন রেলমন্ত্রী নীতীশ কুমারের বক্তব্য  ছিল, “পৃথক রেল বাজেট তুলে দিলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। বরং এই সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রেল তেমন গুরুত্বপূর্ণই নয়। এতে রেলের স্বতন্ত্রতাও ক্ষুণ্ণ হবে।”


ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া


প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ও কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, “স্বাধীনতার আগে থেকেই পৃথক রেল বাজেট ভারতের ঐতিহ্য। এতদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা সরকার, রাজনৈতিক দলগুলি নিশ্চয়ই বোকা নয়! ভারতের মতো দেশে রেলর উন্নয়নে পৃথক বাজেট থাকাই কাম্য।” আর এক রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর যুক্তি ছিল, “এই সিদ্ধান্তে বোঝা যাচ্ছে, সরকারের কাছে রেল আর বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সংসদে আলোচনা করা উচিত ছিল সরকারের। কোনও কিছু ভেঙে ফেলা সহজ। কিন্তু তিলে তিলে একটি পরিকাঠামো দাঁড় করানো বেশ কঠিন।”


অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, ২০১৭ সালের আগে পর্যন্ত, যে সরকারই ক্ষমতায় থেকেছে, রেল বাজেট বরাবরই তাদের কাছে জনমোহিনী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। নিত্যু নতুন ট্রেন, লাইন বর্ধিত করার মতো দেদার ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু আসল কাজ হয়নি। পরিকাঠামোর উপর নজর পড়েনি সে ভাবে। কিন্তু রেল বাজেটকে সাধারণ বাজেটের অন্তর্ভুক্ত করার পর সাধারণ মানুষের কাছে জবাবদিহির আর কোনও দায় সরকারের রইল না বলে সেই সময়ই দাবি করেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা জানান, বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও, পৃথক রেল বাজেট না থাকায় কোন খাতে কত খরচ হচ্ছে, নতুন ট্রেন যে আনা হচ্ছে, সেগুলি থেকে আদৌ কী লাভ হচ্ছে, কোন সংস্থার কাছে কী বরাত যাচ্ছে, শেয়ার বাজারে কী প্রভাব পড়ছে তার এবং সর্বোপরি রেলের আয় ও ব্যায়ের কোনও হিসেব খোলসা করার দায় থাকবে না।   


দুর্ঘটনার নেপথ্যে দুর্বল পরিকাঠামো!


শুক্রবার রাতে ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর স্বভাবতই সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। শনিবার বালেশ্বরে গিয়ে, রেলমন্ত্রীর সামনেই এ নিয়ে সরব হন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন,  "আসলে রেলের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। আগে আট মন্ত্রীর পরিষদ ছিল। এখন রেলের বাজেটই হয় না। আমি রেলের কাজ করেছি। রেল আমার কাছে সন্তানসম। তাই আমার পরামর্শ চাইলে, সবসময় প্রস্তুত।"


রেলের বরাদ্দ এবং খরচ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরীও। তাঁর বক্তব্য, “বার বার বুলেট ট্রেন, বুলেট ট্রেন। শুনলে চমকে যাবেন। রোজ দেশের ২৫ লক্ষ  মানুষ রেলে সফর করেন। অথচ সব অর্থ বুলেট ট্রেনে বরাদ্দ করা হচ্ছে। আবার বন্দে ভারতও রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ খাতে নজর না দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় ভুল, যার ফল ভুগতে হচ্ছে।”


বালেশ্বরের দুর্ঘটনা নিয়ে রেলের তরফে জানানো হয়েছে, যে রুটে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে দুর্ঘটনা  প্রতিরোধী যন্ত্র ‘কবচ’ বসানো যায়নি।  তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার রেলমন্ত্রীর সামনেই তিনি বলেন, “আপনি বিষয়টি দেখুন। আমার কাছে খবর আছে, দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনে দুর্ঘটনা প্রতিরোধী যন্ত্র ছিল না। ভাল করে সবদিক খতিয়ে দেখতে হবে। রেলকে আজকাল গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এই ঘটনায় চূড়ান্ত গাফিলতি রয়েছে। যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভাবা হয় না। খুব খারাপ পরিস্থিতি। দুর্ঘটনা প্রতিরোধী যন্ত্র করে দিয়ে এসেছিলাম আমি। সেটা থাকলে দুর্ঘটনা ঘটত না।"


CPI-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “ভারতীয় রেলের কি আর সিগনাল বা নিরাপত্তা প্রযুক্তির প্রয়োজন নেই? নাকি এমন দুর্ঘটনাও গা সওয়া করে নিতে হবে? নিহত যাত্রী এবং তাঁদের পরিবার-পরিজনকে জবাব দিতে হবে আমাদের।” রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণোর পদত্যাগের দাবিও তুলতে শুরু করেছেন বিরোধীরা।