কলকাতা: নিজের হাতে অন্তত লাখ চারেক গাছের চারা (Sapling) পুঁতেছেন। এখনও, মাসিক বেতনের চল্লিশ শতাংশ বীজ ও গাছের চারা কিনতে খরচ হয়ে যায়। তবে এতেই ঢিলেমি দেওয়ার ইচ্ছা নেই মারিমুথু ইয়োগানাথনের (Marimuthu Yoganathan)। বরং ‘গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান’ স্লোগানের তাৎপর্য কী ভাবে আরও বেশি করে মানুষকে বোঝানো যায়, তাই নিয়েই লড়ে চলেছেন তামিলনাড়ুর (Tamil Nadu) ‘Tree Man’। পেশায় রাজ্য পরিবহণ নিগমের বাস কন্ডাক্টর মারিমুথুর এই উদ্যোগ ইতিমধ্যেই বহু স্বীকৃতি পেয়েছে। এসেছে পুরস্কারও। কিন্তু পুরস্কার বা শিরোপার থেকেও নিজের কাজেই বেশি মগ্ন তিনি। বছরদুয়েক আগেকার কথা। তামিলনাড়ুর ‘দ্য ট্রি ম্যান’ বলেছিলেন, ‘এক সরকারি আধিকারিক হঠাৎ আমার কাছে জানতে চাইলেন পদ্মশ্রী খেতাব পেয়েছি কিনা। জানি না, আমার নাম কেন তালিকায় ওঠেনি। যদিও পুরস্কার আমার মূল লক্ষ্য নয়, তবে এই ধরনের সম্মান পেলে একটা সুবিধা হত। অন্যান্য রাজ্য থেকেও চারাগাছ পোঁতার জন্য আমার কাছে ডাক আসত। সেটাই আমার স্বপ্ন।'
সম্মান ও স্বীকৃতি...
কিছুটা হলেও সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে মারিমুথুর। ২০০৮ সালে দেশের তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির হাত থেকে ‘ইকো ওয়ারিয়র’ সম্মান পেয়েছেন তামিলনাড়ুর সরকারি পরিবহণ নিগমের এই বাস কন্ডাক্টর। শুধু তাই নয়। তামিলনাড়ু সরকার তাঁকে ‘Suttru Suzhal Seyal Veerar’ বা ‘ইকো-ওয়ারিয়র’ উপাধি দেয়। ২০১০ সালে ওয়াইল্ড লাইফ ফিল্মমেকার মাইক পান্ডে ও চিত্রতারকা জন আব্রাহামের হাত থেকে 'Unsung Hero' পুরস্কারও পান মারিমুথু। ২০২১ সালের ’মন কি বাত’-র ৭৫তম পর্বে তাঁর উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
কী বদলাল?
সরকারি পরিবহণ নিগমের কর্মচারী হিসেবে বদলি তাঁর চাকরির অংশ। কিন্তু সার্ভিসের প্রথম ১৭ বছরেই অন্তত ৪০ বার বদলির জেরে ধাক্কা খেয়েছিল মারিমুথুর সবুজায়নের উদ্যোগ। পারিবারিক জীবনও বেশ চাপের মধ্যে পড়ে। কিন্তু থামেননি ইকো ওয়ারিয়র। অবশেষে একের পর এক পুরস্কার ও সম্মান টনক নড়ায় তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। এখন কাজের জায়গার ছবিটা কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক।
কী করেন ‘Tree Man’?
সবুজ বাঁচানোর জন্য নিজের হাতে বৃক্ষরোপণ করার পাশাপাশি আরও একাধিক উদ্যোগে সামিল মারিমুথু। পরিবেশ রক্ষার এই লড়াই যে ‘একা কুম্ভ’ তাঁকে দিয়ে জেতা যাবে না, সেটা বুঝেছেন তিনি। তাই আরও অনেক ‘মারিমুথু ইয়োগানাথন’ তৈরির জন্য স্কুল, কলেজ, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্পোরেট সংস্থায় প্রায়ই পৌঁছে যান এই পরিবেশ আন্দোলনকারী। সাপ্তাহিক ছুটির দিন মানেই এই ধরনের কোনও না কোনও উদ্যোগে দেখা যাবে এই ‘ইকো ওয়ারিয়র’ -কে। নিজের পিএফ থেকে ঋণ নিয়ে ৩৭ হাজার টাকার একটি এলসিডি প্রোজেক্টর কেনেন মারিমুথু। বিশেষ করে কচিকাচাদের মধ্যে পরিবেশ নিয়ে উৎসাহ তৈরি করতেই নানা ধরনের অজানা তথ্য এই এলসিডি প্রোজেক্টরের মাধ্যমে তুলে ধরেন তিনি। বছরদুয়েক আগে পর্যন্ত যা পরিসংখ্যান, তাতে স্কুল-কলেজ-কলকারখানা মিলিয়ে এমন ৩ হাজার ৭৪৩টি জায়গায় পরিবেশ সচেতনতা সংক্রান্ত ক্লাস নিয়েছেন দ্বাদশ শ্রেণি পাশ এই বাস কন্ডাক্টর। শুধু নীরস বক্তৃতা নয়,এই জন্য নিজের মতো করে পথনাটিকাও করেছেন মারিমুথু। এবং এই সব কাজই চলেছে সরকারি বাসে কন্ডাক্টরের চাকরি করার পাশাপাশি।
সহজ নয়...
পথটা সহজ ছিল না একেবারে ছোটবেলা থেকেই। থাঞ্জাভুর জেলার মায়াভরমে ‘দিন আনি, দিন খাই’ পরিবারে জন্মেছিলেন মারিমুথু। ছোটবেলায় বাবা মারা যান। মা কাজের খোঁজে নীলগিরির চা বাগানে চলে এসেছিলেন। ছোট ছেলেটিকে রেখে এসেছিলেন বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে। সেখানেই বড় হয়ে ওঠা মারিমুথুর। কিন্তু মাঝেমধ্যে নীলগিরি আসতেন তিনি। ক্লাস ইলেভেনে ওঠার পর কোটাগিরির একটি স্কুলে ভর্তি হন। সেই সময়, অর্থাৎ স্কুলে পড়াকালীনই নীলগিরির কাঠ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন মারিমুথু। হাতে লেখা পোস্টার, কোথায় কোথায় গাছ কাটা হয়েছে সেই এলাকা চিহ্নিত করা এবং পুলিশ ও বন দফতরকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের জন্য আর্জি জানানো--সমস্ত করত খুদে মারিমুথু। কোটাগিরিতেই সবুজ আন্দোলনকারী জয়াচন্দ্রনের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। সেখান থেকেই পরিবেশ রক্ষার তাগিদ আরও বাড়ে। লেখাপড়ায় তেমন উৎসাহ না থাকলেও পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু জানতে পারলে দ্রুত শিখে নিতেন। দারিদ্র্য, প্রথাগত ডিগ্রির অভাব, চাকরিতে নানা বাধা কোনও কিছুই আটকাতে পারেনি এই ‘যোদ্ধাকে’। বরং সংঘর্ষ করে এগিয়ে গিয়েছেন মারিমুথু। ভবিষ্যতে আরও ছড়িয়ে দিতে চান এই উদ্যোগকে। যে ভাবে রোদ-জল-ঝড় সত্ত্বেও গাছের চারা একদিন পাতা-ফল-ফুলে ভরে ওঠে, প্রাণবায়ুতে সকলকে ভরিয়ে দেয়, সে ভাবেই সবুজে তামিলনাড়ু তথা গোটা দেশকে ভরিয়ে দিতে চান এই পরিবেশ-যোদ্ধা।
আরও পড়ুন:ত্বকের জেল্লা বজায় রাখতে রোজের মেনুতে রাখুন জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার, কী কী খেতে পারেন?