নয়াদিল্লি: চলতি মাসেই শুরু হতে চলেছে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। আগামী ২৫ নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে, চলবে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের দু'দিন পর শুরু হচ্ছে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। এবারের শীতকালীন অধিবেশনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস করাতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। (Parliament Winter Session)
মঙ্গলবার শীতকালীন অধিবেশন শুরুর দিন ক্ষণ জানান কেন্দ্রের সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু। তিনি জানিয়েছেন, লোকসভা এবং রাজ্যসবার শীতকালীন অধিবেশন শুরুর প্রস্তাব দিয়েছিল কেন্দ্র। সেই মতো, অনুমতি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। আগামী ২৬ নভেম্বর ৭৫তম সংবিধান দিবস। এই দিনেই দেশের সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। তাই এবারের শীতকালীন অধিবেশনে সংবিধান সদনের সেন্ট্রাল হলে দিনটি পালিত হবে বলে জানিয়েছেন রিজিজু। (Waqf (Amendment) Bill)
এবারের শীতকালীন অধিবেশনে সংসদে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিল পেশ করতে পারে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার, যার মধ্যে অন্যতম হল ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল ২০২৪, 'এক দেশ, এক নির্বাচন' বিল। এর মধ্যে ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল নিয়ে ইতিমধ্যেই টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। যৌথ সংসদীয় কমিটির (JPC) বৈঠকে একতরফা ভাবে বিল নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিরোধীরা। সেই নিয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান জগদম্বিকা পালের বিরুদ্ধে লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লাকে চিঠিও দিয়েছেন বিরোধী শিবিরের সাংসদরা। তাঁর বিরুদ্ধে স্বৈরাচারের অভিযোগ তুলেছেন। পদক্ষেপ না করা হলে যৌথ সংসদীয় কমিটি থেকে ইস্তফা দেবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিরোধী শিবিরের সাংসদরা। (One Nation One Election)
ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল
এই ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল নিয়ে গোড়া থেকেই বিতর্ক। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অতীশীও সম্প্রতি সেই নিয়ে চিঠি দেন, যাতে তিনি অভিযোগ করেন, দিল্লি সরকারের অনুমতি ছাড়াই রিপোর্ট জমা দিয়েছেন ওয়াকফ বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক অশ্বিনী কুমার। এমনকি এই ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল নিয়ে সংসদীয় বৈঠকে কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি তথা অধুনা বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঝামেলা বাধে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বোতল ছুড়তে গিয়ে কল্যাণের হাতও কেটে যায়। (Winter Session of Parliament)
ওয়াকফ (সংশোধনী) বিলে বলা হয়েছে, ১) কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফ ঘোষণার অধিকার আর ওয়াকফ বোর্ডের হাতে থাকবে না, বরং জেলাশাসকরা সিদ্ধান্ত নেবেন। ২) ওয়াকফ বোর্ডে দুই মহিলা সদস্যের পাশাপাশি, দুই অমুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি রাখাও বাধ্যতামূলক। ৩) মুসলিম এবং অন্তত পক্ষে পাঁচ বছর ধরে যাঁরা ইসলাম ধর্ম পালন করে আসছেন, একমাত্র তাঁরাই ওয়াকফ বোর্ডকে সম্পত্তি দান করতে পারবেন। ৪) হিন্দু মন্দিরের মতো ওয়াকফ বোর্ডও ধর্মনিরপেক্ষ বিধিবদ্ধ সংস্থা বলে গন্য হবে। এর আগে লোকসভায় সংশোধনী বিলটি পেশ করা হলে, বিরোধীরা আপত্তি জানান। শেষ পর্যন্ত একমত হতে যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে বিলটি পাঠানো হয়। কিন্তু একতরফা ভাবে, অন্যায় ভাবে কমিটির চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন বলে অভিযোগ বিরোধীদের।
কেন্দ্রের প্রস্তাবিত ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল নিয়ে বিরোধীদের দাবি, আসলে ওয়াকফ বোর্ডের গুরুত্ব খর্ব করাই এই বিলের লক্ষ্য। ওয়াকফ বোর্ডে মহিলাদের উপস্থিতির প্রস্তাবকে যদিও স্বাগত জানানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, অন্য ধর্মীয় সংস্থাগুলির বোর্ডে ভিন্ ধর্মের প্রতিনিধিদের স্থান নেই যেখানে, সেখানে ওয়াকফ বোর্ডের জন্য ভিন্ ধর্মের প্রতিনিধির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে কেন? অতি সম্প্রতি যদি কোনও ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে থাকেন, সেক্ষেত্রে কেন সম্পত্তি দান করার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে কেন, এই প্রশ্নও তুলেছেন বিরোধীরা। অন্য ধর্মের বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে বলে দাবি তাঁদের। ওয়াকফ বোর্ডকে 'ধর্মনিরপেক্ষ' হতে হবে বলে প্রস্তাব দেওয়া হলেও, পুরীর মন্দিরে কেন অহিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, সেই প্রশ্নও তুলেছেন বিরোধীরা। মুসলিমদের হাতে থাকা জমি কেড়ে নিতেই সংশোধনী বিল আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডও। যদিও সম্প্রতি নির্বাচনী গুরুগ্রামে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে অমিত শাহ জানান, শীতকালীন অধিবেশনে ওয়াকফ (সংশোধী) বিল নিয়ে জটিলতার অবসান ঘটবে।
এক দেশ, এক নির্বাচন
এর পাশাপাশি, শীতকালীন অধিবেশনে 'এক দেশ, এক নির্বাচন' বিলও পেশ করতে পারে কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ইতিমধ্যেই অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে তাতে। এর আওতায়, গোটা দেশে বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচন একসঙ্গে করানোর চেষ্টায় রয়েছে কেন্দ্র। সেই নিয়েও গোড়া থেকে আপত্তি তুলে আসছেন বিরোধীরা। তাঁদের দাবি, 'এক দেশ এক নির্বাচন' চালু হলে, রাজ্যের স্থানীয় সমস্যাগুলি উপেক্ষিত থেকে যাবে। একসঙ্গে সব নির্বাচন হলে বড় দলগুলি যে পরিমাণ অর্থ খরচ করবে, তার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারবে না ছোট দলগুলি। পাশাপাশি, নির্বাচনের পর পর সরকার পড়ে গেলে, কী ঘটবে, সেই নিয়ে বিকল্প ব্যবস্থার উল্লেখ নেই বলেও দাবি বিরোধীদের।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও 'এক দেশ এক নির্বাচন' করানোর প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। কেন্দ্রকে সেই নিয়ে চিঠিও দেন তিনি। তাঁর দাবি, এই নীতি চালু হলে দেশে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। এই নীতি ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী। শুধু তাই নয়, 'এক দেশ এক নির্বাচন' নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করতে যে কমিটি গঠন করা হয়, সেই নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কোবিন্দ ছাড়াও ওই কমিটিতে ছিলেন শাহ, রাজ্যসভায় প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা গোলাম নবি আজাদ, অর্থ কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এনকে সিংহ, লোকসভা সেক্রেটারি জেনারেল সুভাষ সি কাশ্যম, বর্ষীয়ান আইনজীবী হরিশ সালভে, ভিজিলান্স কমিশনের প্রাক্তন প্রধান সঞ্জয় কোঠারি, যাঁরা মোটামুটি ভাবে বিজেপি ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। ফলে বিশেষ একটি দলের রাজনৈতিক স্বার্থ মাথায় রেখেই এই নীতি আনতে এত তৎপরতা বলে অভিযোগ করেন বিরোধীরা।