নয়াদিল্লি: দেশের সংসদে বেনজির পরিস্থিতি। সরকারের জবাবদিহি চেয়ে পর পর ১৪১ জন সাংসদকে সাসপেন্ড হতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের সংসদীয় ব্যবস্থায় এমন পরিস্থিতি কখনও দেখা দেয়নি বলে মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের (Parliament MPs Suspension)। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার যাবতীয় নিয়ম-কানুন ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সরকার চালাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলতে শুরু করেছেন বিরোধীরা। এ নিয়ে কী বলছে নিয়ম-কানুন, জানুন বিশদ। (Parliament Rules)


সাংদদের বিরোধিতা


সংসদে সাংসদদের বিরোধিতার রীতি চলে আসছে বহু দশক ধরে। বিজেপি বনাম কংগ্রেস-তৃণমূল নয়, ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলগুলির মধ্যে এযাবৎ এই রীতিই চলে এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার সময় না পাওয়া গেলে, সরকার প্রশ্নের উত্তর না দিলে, ট্রেজারি বেঞ্চের প্রতিশোধপূর্ণ আচরণ, ইচ্ছাকৃত ভাবে সংসদের অধিবেশন বিঘ্ন ঘটানো হলে এবং উপদ্রব ঘটানো সাংসদদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ না করা হলে, বিক্ষোভ দেখান সাংসদরা। বিরোধী শিবিরের সাংসদদের প্রশ্নের উত্তরে দিতে বাধ্য সরকার। গত ৭০ বছর ধরে এই রীতিতে কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। 


সাংসদদের সাসপেন্ড করার অধিকার


প্রিসাইডিং অফিসার অর্থাৎ, লোকসভার স্পিকার এবং রাজ্যসভার চেয়ারম্যান সাংসদদের সাসপেন্ড করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। লোকসভার স্পিকার সংসদীয় আইনের ৩৭৩, ৩৭৪ এবং ৩৭৪A ধারা অনুযায়ী পদক্ষেপ করেন। রাজ্যসভার চেয়ারম্যান পদক্ষেপ করেন ২৫৫, ২৫৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী। 


আরও পড়ুন: Opposition Meet: ৯২ সাংসদের সাসপেনসনের আবহে আজ গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে I.N.D.I.A ব্লক, আলোচনায় কী ?


এক্ষেত্রে অসংসদীয় আসনের জন্য লোকসভায় ৩৭৩ এবং রাজ্যসভায় ২৫৫ ধারার আওতায় প্রথমে বিক্ষোভকারী সাংসদকে ভবন কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে ছাওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন প্রিসাইডিং অফিসার। নির্দেশ যদি মানতে অস্বীকার করেন সংশ্লিষ্ট সাংসদ এবং অধিবেশনের কাজে বাধা দিতে থাকেন, সেক্ষেত্রে সরাসরি ওই সাংসদের নাম উল্লেখ করেন প্রিসাইডিং অফিসার, লোকসভায় ৩৭৪ এবং রাজ্যসভায় ২৫৬ ধারার আওতায়। তার পর ওই সাংসদকে সাসপেন্ড করার প্রস্তাব জমা পড়ে। 


১৯৫২ সাল থেকে এই নিয়মই চালু ছিল। ২০০১ সালে লোকসভার স্পিকারের ক্ষমতা আরও বাড়ানো হয়। তাতে বাল হয়, নয়া ৩৭৪A ধারা অনুযায়ী,  স্পিকার যে সাংসদের নাম উল্লেখ করবেন, আপনাআপনিই পাঁচ দিনের জন্য অথবা গোটা অধিবেশনের জন্য সাসপেন্ড হয়ে যাবেন তিনি। অর্থাৎ ওই সাংসদের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস হওয়ার কোনও প্রয়োজন হবে না।


কিন্তু নয়া নিয়ম শুধুমাত্র লোকসভার জন্যই কার্যকর করা হয়। রাজ্যসভার ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের ক্ষমতাবৃদ্ধির নতুন কোনও বিধি কার্যকর করা হয়নি। যে কারণে সোমবার রাজ্যসভার চেয়ারম্যান নামের উল্লেখ করার পর, সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী প্রস্তাব জমা দেন। ধ্বনিভোটে সেই প্রস্তাব পাস হলে বিরোধী শিবিরের সাংসদরা সাসপেন্ড হন।


কতদিনের জন্য সাসপেন্ড করা যেতে পারে সাংসদদের


ছোটখাটো বিষয় হলে শুধুমাত্র তিরস্কার করেই ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু লোকসভার স্পিকারের যদি মনে হয়, কোনও সাংসদের আচরণে সংসদের পবিত্রতা নষ্ট হয়েছে বা অসংসদীয় আচরণ করেছেন তিনি, তাহলে ৩৭৩ ধারায় পদক্ষেপ করা যেতে পারে। তিনি তৎক্ষণাৎ ওই সাংসদকে অধিবেশন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলতে পারেন। তাঁর নির্দেশ মানতে বাধ্য সংশ্লিষ্ট সাংসদ।


প্রিসাইডিং অফিসারের নির্দেশ না মেনে বিক্ষোভ চালিয়ে গেলে আরও কড়া শাস্তির মুখোমুখি হতে পারে সাংসদদের। সেক্ষেত্রে সাসপেন্ড করা হতে পারে তাঁকে। সর্বাধিক গোটা অধিবেশনের জন্য কোনও সাংসদকে সাসপেন্ড করা যেতে পারে। তবে অন্য প্রস্তাব এনে, সাসপেন্ড হওয়া সাংসদকে ফিরিয়ে আনার উপায়ও রয়েছে। গুরুতর অভিযোগ থাকলে, সংসদে থাকার অনুপযুক্ত বলে কোনও সাংসদকে বহিষ্কারও করা যেতে পারে। 


যখন তখন সাংসদদের সাসপেন্ড করা যায় কি?


সাংসদদের সাসপেন্ড করার ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু একসঙ্গে শতাধিক সাংসদকে সাসপেন্ড করার ঘটনা বেনজির। লোকসভা এবং রাজ্যসভা মিলিয়ে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৮১ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়। সেই নিরিখে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মতো সাসপেন্ড হন মাত্র ৩৬ জন সাংসদ। কিন্তু গত কয়েক দিনে পর পর বেনজির ঘটনা ঘটেছে। গত সপ্তাহে তৃণমূলের ডেরেক ও'ব্রায়েন-সহ একদিনে প্রথমে ১৪ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়। সোমবার এবং মঙ্গলবার আরও দলে দলে বিরোধী সাংসদদের সাসপেন্ড করা হয়েছে। সবমিলিয়ে সংসদের চলতি শীতকালীন অধিবেশনে ১৪১ জন সাংসদ সাসপেন্ড হলেন, যাঁরা সকলেই প্রায় বিরোধী শিবিরের, যা এখনও পর্যন্ত সর্বাধিক।