নয়াদিল্লি: দেশে তৈরি কফ সিরাপে বিপত্তি। এবার রাজস্থান থেকে ভয়ঙ্কর ঘটনা সামনে এল। বাজার থেকে কেনা কফ সিরাপ মুখে ঢালার পর দুই শিশু মারা গিয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে কমপক্ষে আরও ১০ শিশু। শুধু তাই নয়, কফ সিরাপটি নিরাপদ বলে দাবি করে, নিজে চেখে তার প্রমাণ দিতে গিয়েছিলেন এক ডাক্তার। গাড়ির মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান তিনি। প্রায় আট ঘণ্টা পর উদ্ধার করা হয় তাঁকে। (Cough Syrup Deaths)
রাজস্থান সরকারের জন্য যে সংস্থা কফ সিরাপ উৎপাদন করে, তাদের পণ্যের গুণমান নিয়েই এই মুহূর্তে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ওই কফ সিরাপ গলায় ঢালার পর সেখানে দুই শিশু মারা গিয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে আরও ১০ শিশু। গত দুই সপ্তাহে পর পর এমন ঘটনা ঘটে গিয়েছে বিজেপিশাসিত রাজ্যটিতে। কফ সিরাপটির বেশ কয়েকটি ব্যাচকে ‘বিপজ্জনক’ বলে মনে করা হচ্ছে, যাতে ডেক্সট্রোমিথোরফান হাইড্রোব্রোমাইড (Dextromethorphan Hydrobromide) রয়েছে। Kayson Pharma নামের একটি সংস্থা সেটি তৈরি করে। মধ্যপ্রদেশেও কফ সিরাপে ছয় শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ সামনে আসছে। (Rajasthan Cough Syrup Deaths)
সোমবার বিষয়টি নিয়ে টনক নড়ে সকলের। ওই দিনই পাঁচ বছর বয়সি একটি শিশুকে কফ সিরাপটি দেওয়া হয়েছিল। সেটি গলায় ঢালার কয়েক ঘণ্টা পরই মারা যায় শিশুটি। মৃত শিশুটি রাজস্থানের সিকারের বাসিন্দা, নাম নীতীশ। ঠান্ডা লেগে কাশি হচ্ছিল তার। রবিবার মা-বাবা শিশুটিকে চিরানার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখানকার চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনে ওই কফ সিরাপটি লিখে দেন। রবিবার রাত ১১টা বেজে ৩০ মিনিট নাগাদ ছেলের গলায় ওই কফ সিরাপ ঢেলে দেন নীতীশের মা। এর পর রাত ৩টে নাগাদ আচমকাই ঘুম ভেঙে ওঠে নীতীশ। হেঁচকি উঠতে থাকে তার। মা জল দেয় তাকে। এর পর ছেলেকে ফের ঘুম পাড়ান তিনি। কিন্তু তার পর আর ঘুম ভাঙেনি নীতীশের।
সোমবার সকালে ছোট্ট নীতীশকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। নীতীশের পরিবার জানিয়েছে, সারা দিন ঠিকই ছিল নীতীশ। সন্ধেয় নবরাত্রির অনুষ্ঠানেও গিয়েছিল। রাতে কাশতে শুরু করলে ওই কফ সিরাপ দেওয়া হয় তাকে। তার পরই আর ঘুম ভাঙেনি তার। নীতীশের মৃত্যুর খবর সামনে আসার পর অন্য অভিভাবকরাও একে একে মুখ খুলতে শুরু করেন। জানা যায়, ২২ সেপ্টেম্বর ওই কফ সিরাপ গলায় ঢালার পর মারা যায় মালহা গ্রামের সম্রাট জাটব দু’বছরের একটি শিশুও। সম্রাটের তুতো দাদা ও দিদি, সাক্ষী এবং বিরাটকেও ওই কফ সিরাপ দেওয়া হয়েছিল রাত ১.৩০টা নাগাদ। পাঁচ ঘণ্টা পরও তাদের ঘুম না ভাঙায় সকলে চিন্তিত হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত সাক্ষী এবং বিরাটকে জাগানো সম্ভব হয়। উঠেই বমি করে তারা। কিন্তু সম্রাটকে জাগানো যায়নি। ভরতপুরের স্থানীয় হাসপাতালে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখান থেকে স্থানান্তরিত করা হয় জেকে লোন হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকরা শিশুটিকে মৃত বলে ঘোষণা করে।
বায়ানায় তিন বছর বয়সি গগন কুমারকে ২৪ সেপ্টেম্বর ওই কফ সিরাপ দেওয়া হয়। সেটি গলায় ঢালার পর সে-ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এটা শিশুটির মা সটান স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হাজির হন। যে চিকিৎসক ওই কফ সিরাপ লিখেছিলেন প্রেসক্রিপশনে, তাঁকে গোটা বিষয়টি জানান, কৈফেয়ত চান। তারাচাঁদ যোগী নামের ওই চিকিৎসক দাবি করেন, কফ সিরাপে কোনও সমস্যা নেই। নিজের দাবি প্রমাণ করতে নিজে ওই কফ সিরাপ গলায় ঢালেন তিনি। অ্যাম্বুল্যান্স চালক রাজেন্দ্রকেও সেটি চেখে দেখতে বলেন। এর পর গাড়ি নিয়ে ভরতপুরের উদ্দেশে রওনা দেন ওই চিকিৎসক। কিন্তু কয়েক রাস্তায় অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন। রাস্তার ধারে কোনও রকমে গাড়ি থামান। এর পরই সংজ্ঞা হারান। তাঁর হাল-হাকিকত জানতে না পেরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন পরিবার-সহ সকলে। এর পর, মোবাইলের লোকেশন ধরে আট ঘণ্টা পর তাঁর কাছে পৌঁছনো সম্ভব হয়। দেখা যায়, গাড়ির মধ্যে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছেন তিনি। অ্যাম্বুল্যান্স চালক রাজেন্দ্রও একই ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে চিকিৎসার পর আপাতত সুস্থ তাঁরা।
বাঁশওয়ারাতেও গত এক সপ্তাহে এক থেকে পাঁচ বছর বয়সি আট শিশু ওই কফ সিরাপের দরুণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে খবর। পর পর এমন ঘটনায় ওই কফ সিরাপের ২২টি ব্যাচকে নিষিদ্ধ করেছে রাজস্থানে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। বাজারে ওই কফ সিরাপের বিক্রিবাটা আপাতত বন্ধ। রাজস্থান স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, জুলাই মাস থেকে ওই কফ সিরাপের ১.৩৩ লক্ষ বোতল তুলে দেওয়া হয়েছে রোগীদের হাতে। জয়পুরের SMS হাসপাতালের স্টকে রয়েছে ৮২০০ বোতল। সেগুলি যাতে কোনও রোগীকে দেওয়া না হয়, নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য। বাঁশওয়ারার MG হাসপাতালের চিকিৎসক প্রদ্যুম্ন জৈন জানিয়েছেন, ওই কফ সিরাপ গলায় ঢালার পর শিশুদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। ওভারডোজের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ছ’বছরের একটি শিশুর অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। তবে সেরে উঠেছে সে।
রাজস্থান মেডিক্যাল সার্ভিসেস কর্পোরেশন লিমিটেডের গুণমান যাচাই বিভাগের ডিরেক্টর জয় সিংহ জানিয়েছেন, আপাতত ওই কফ সিরাপ কাউকে দিতে বারণ করা হয়েছে চিকিৎসকদের। ২২টি ব্যাচের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চলছে। Kayson Pharma-র ওই কফ সিরাপের সরবরাহ আপাতত বন্ধ। এর আগে ২০২৩ সালেও Kayson Pharma-র একটি কফ সিরাফ নিষিদ্ধ হয় বলে জানিয়েছেন রাজস্থানের ড্রাগ কন্ট্রোলার অজয় পাঠক, তাতে মেন্থলের মাত্রা অত্যন্ত কম ছিল বলে জানা যায়। Kayson Pharma-র তরফে এখনও পর্যন্ত কোনও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি এ নিয়ে।
অন্য দিকে, মধ্যপ্রদেশ থেকেও এমনই ঘটনা সামনে এসেছে। গত একমাসে সেখানকার ছিন্দওয়ারায় ছয় শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে খবর। একই ধরনের কফ সিরাপে তাদের কিডনিতে সংক্রমণ হয় বলে অভহিযোগ। Coldrif এবং Nextro-DS সিরাপ দু'টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেখানে।