জয়পুর: আগাগোড়া কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত তিনি। স্রোতে গা ভাসিয়ে নোঙর করেননি অন্য কোথাও। বরং লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সয়েও রয়ে গিয়েছেন। কিন্তু নিজের দলের সরকারের বিরুদ্ধেই এ বার অনশন-ধর্নায় বসলেন সচিন পায়লট (Sachin Pilot)। দলের তরফে যদিও বার বার নিষেধ করা হয়েছিল তাঁকে। 'দলবিরোধী কাজকর্ম' নিয়ে দেওয়া হয়েছিল সতর্কবার্তাও। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তেই অনড় থাকলেন সচিন। মঙ্গলবার অনশন-ধর্নায় বসলেন তিনি (Rajasthan Congress)। 


মূলত তাঁর নিশানায় রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত


বিধানসভা নির্বাচনে (Rajasthan Assembly Elections 2023) যখন কয়েক মাস বাকি, সেই সময় সচিনের এই পদক্ষেপ আরও অস্বস্তিতে ফেলেছে রাজস্থান কংগ্রেসকে। তবে দল নয়, মূলত তাঁর নিশানায় রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত। প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও গহলৌত সরকার পূর্বতন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি নিয়ে পদক্ষেপ করেনি বলে অভিযোগ সচিনের। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে সেই প্রতিশ্রুতি পালনের দাবি তুলেছেন তিনি। সেই দাবি নিয়েই বসেছেন অনশন-ধর্নায়। 


রাজস্থানে বিধানসভা নির্বাচনে মেরেকেটে ছ’মাস বাকি। তার আগে নিজের অবস্থানের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে সচিন জানিয়েছেন, গহলৌত সরকারের এই নিষ্ক্রিয়তাকে হাতিয়ার করতে পারে বিরোধী দলগুলি।  গোপন সমঝোতার অভিযোগও খাড়া করা হতে পারে। তাতে কংগ্রেস কর্মীরাও হতাশ হতে পারেন। ভাবতে পারেন কথার সঙ্গে কাজের বিস্তর ফারাক রয়ে গিয়েছে। তাই তাঁর বক্তব্য, “প্রতিশ্রুতি অধরা রেখে পরবর্তী নির্বাচনে এগোতে পারব আমরা। আমাদের কাছে সব প্রমাণ রয়েছে। তদন্ত শুরু হওয়া উচিত। নির্বাচন আসছে। আদর্শ নির্বাচনী বিধিও জারি হয়ে যাবে। মানুষের কাছে জবাবদিহির দায়বদ্ধতা রয়েছে আমাদের।”


এ দিন জয়পুরে 'শহিদ স্মারক স্থলে' অনশন-ধর্নায় বসেন সচিন। সাক্ষী করেন মহাত্মা গান্ধীকে। অনশন স্থলে মহাত্মার ছবি চোখে পড়ে। পূর্বতন বসুন্ধরা রাজে সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে একদিনের অনশনে বসেছেন বলে সাফ জানিয়েছেন সচিন। গহলৌত সরকার যদিও অভিযোক অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, নির্বাচনের মুখে এমন পদক্ষেপ করে দলের অস্বস্তি বাড়ানো বই কমাননি সচিন।


আরও পড়ুন: Adani Group: বিদেশি বিনিয়োগের নামে কোম্পানিতে ঢুকেছে পরিবারের টাকা! কী বলছে আদানি গ্রুপ ?


অনশন-ধর্না থেকে বিরত করতে এর আগে সচিনকে সতর্কও করেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। রাজস্থানে কংগ্রেসের ইনচার্জ সুখজিন্দর সিংহ রণধাওয়া বলেন, "সচিন পায়লটের একদিনের অনশন-ধর্না দলের স্বার্থের পরিপন্থী এবং দলবিরোধী কাজের মধ্যে পড়ে।  নিজেদের সরকারের সঙ্গে কোনও মতবিরোধ থাকলে, দলের ফোরামে তা নিয়ে আলোচনা করা উচিত, জনসাধারণ এবং সংবাদমাধ্যমের সামনে নয়।" পাঁচ মাস তিনি দায়িত্বে থাকার পরও একবারও তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে সচিন আলোচনা করেননি বলেও দাবি করেন রণধাওয়া। 


গহলৌত সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার নেপথ্য কারণ হিসেবে দুর্নীতির প্রশ্ন তুলে ধরেছেন যদিও সচিন। তবে কংগ্রেসের একাংশই বলছেন, নির্বাচনের মুখে গহলৌতের সঙ্গে পুরনো হিসেব মিটিয়ে নিতে চাইছেন সচিন। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা দ্বন্দ্ব যাতে ফের তাঁর পথের বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, তাই দলের উপর চাপ সৃষ্টি করছেন তিনি। 


সচিন এবং গহলৌত দ্বৈরথ নতুন কোনও ঘটনা নয়। গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই দু’জনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে, যা গোপন নেই কারও কাছেই। ২০১৮ সালে রাজস্থানে কংগ্রেস বিজয়ী হওয়ার পর সচিনই মুখ্যমন্ত্রী হবেন বলে শোনা যায়। জানা যায়, পাঁচ বছরের মেয়াদকাল সচিন এবং গহলৌত নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।


সেই অনুযায়ী, অভিজ্ঞ হওয়ার দরুণ প্রথম আড়াই বছর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানোর কথা ছিল গহলৌতের। পরের আড়াই বছর সচিন মুখ্যমন্ত্রীর আসন সামলাবেন বলে কথা ছিল।   কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও, বাস্তবে তা ঘটেনি। ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রী হয়েই থাকতে হয়েছে সচিনকে। ২০২০ সালে তা নিয়ে বিদ্রোহও ঘোষণা করেন পায়লট। নিজের অনুগামী ২০ জন বিধায়ককে নিয়ে দিল্লির কাছে রিসর্টে আশ্রয় নেন। আসন ছাড়া না হলে তিনি দল ভেঙে বেরিয়ে যাবেন হুঁশিয়ারি দেন।


কিন্তু কৌশলে তাঁকে মাত দেন গহলৌত। সচিনের ডাকে তেমন কেউ সাড়া দেননি। উল্টে বিদ্রোহ ঘোষণার জন্য ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রীর পদ হারাতে হয় তাঁকে। রাজস্থান প্রদেশ কংগ্রেসের দায়িত্বও হাতছাড়া হয় শাস্তিস্বরূপ। এর পর, ২০২২ সালে সনিয়া গান্ধী খোদ রাজস্থান প্রদেশ কংগ্রেসের দায়িত্ব হস্তান্তরিত করতে নির্দেশ দেন গহলৌতকে। তাতে নিজের দলবল নিয়ে শক্তি প্রদর্শন করেন গহলৌত।


সচিন এবং গহলৌত দ্বৈরথ নতুন কোনও ঘটনা নয়


রাহুল গান্ধীর সুপারিশ করা ‘এক ব্যক্তি , এক পদ’ নীতির বিপরীত পথে হেঁটে গহলৌত জানিয়ে দেন, প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতিত্ব এবং মুখ্যমন্ত্রিত্ব, দুই পদই নিজের দখলে রাখবেন তিনি।  এর পর সনিয়া খোদ দেখা করেন গহলৌতের সঙ্গে। দলের অসন্তোষের কথা জানান। তাতে ক্ষমাও চান গহলৌত। কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদ ছেড়ে দিলেও, মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়েননি তিনি। রাজস্থান প্রদেশ কংগ্রেসের চেয়ারপার্সনও তিনি।


 তার পর থেকে কংগ্রেস নেতৃত্বের তরফে একাধিক বার সচিন এবং গহলৌতের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ঘোচানোর চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু হয়নি কাজের কাজ। এখন নির্বাচনের আগে পুরনো ক্ষত ব্যথা ধরাচ্ছে।