নয়াদিল্লি: প্রতি বছর গালভরা প্রতিশ্রুতি। নিত্য নতুন ট্রেনের ঘোষণা। কিন্তু রেল পরিষেবার অবস্থা যে তথৈবচ, আবারও তার প্রমাণ মিলল। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনাকে ঘিরে ফের প্রশ্নের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার। দেশের জনসংখ্যার বড় অংশের ভরসা যে রেল, তার পরিষেবায় গাফিলতির অভিযোগ তুলছে। গত ১০ বছরে পর পর এতগুলি ট্রেন দুর্ঘটনার পরও কেন পৃথক রেল বাজেট পেশ হচ্ছে না, আবারও প্রশ্ন উঠছে। (Separate Rail Budget)


কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনাগ্রস্ত হওয়ার পর সোমবারই ব্যবস্থাপনা এবং রেল বাজেট নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, "জানি না, এসব কী চলছে। রেল মন্ত্রক আছে, কিন্তু রেলের আগের সেই মাধুর্য নষ্ট করে দিয়েছে। অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে রেল। আগে একটা শ্রী ছিল। পরিষেবা, খাবারের গুণমানও খারাপ। রেলের যে ডিপার্টমেন্ট,সেখানে ইহাও হয়, উহাও হয়। বাজেটটাও তুলে দিয়েছে।" (Kanchenjunga Express Train Accident)


কংগ্রেসের তরফেও এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। রেলের সুরক্ষা প্রযুক্তি 'কবচে'র একটি বিজ্ঞাপন তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সরাসরি নিশানা করেছে তারা। কংগ্রেসের বক্তব্য, "শুধু বিজ্ঞাপনের বহর। এখন কোথায় গেলেন"? সংযুক্ত জনতা দলেরনেতা তথা সংসদের রেল স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য কৌশলেন্দ্র কুমারের বক্তব্য, "দেশে ট্রেন দুর্ঘটনা বেড়েছে। রেলের জন্য বরাদ্দ টাকা নিরাপত্তা, রেললাইন এবং ট্রেনের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে খরচ হওয়া উচিত। একমাত্র রেলমন্ত্রকেরই পৃথক বাজেট ছিল। কিন্তু এখন তা কেন্দ্রীয় বাজেটের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।"


সেই ইংরেজ আমল থেকেই রেলের পৃথক বাজেট ছিল দেশে। ২০১৭ সালের আগে পর্যন্ত সেই নিয়মই কার্যকর ছিল। কেন্দ্রীয় বাজেটের কয়েক দিন আগে রেল বাজেট পেশ হতো সংসদে। কিন্তু ২০১৭-'১৮ অর্থবর্ষে সেই রীতিতে দাঁড়ি টানে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার। সে বছর কেন্দ্রীয় বাজেটের সঙ্গেই রেল বাজেটকে মিলিয়ে পেশ করেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। 



কেন, কী কারণে প্রায় ১০০ বছরের রীতিতে ছেদ টানা হল, তার সপক্ষে স্পষ্ট যুক্তি দেওয়া হয়নি কেন্দ্রের তরফে।  সময় বাঁচাতেই রেল বাজেটকে কেন্দ্রীয় বাজেটের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দায়সারা উত্তর মেলে, যা নিয়ে গোড়া থেকেই প্রশ্ন তুলে আসছেন বিরোধীরা। পৃথক রেল বাজেটে কোন খাতে কত বরাদ্দ করা হচ্ছে, সেই নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেত। পৃথক রেল বাজেট পেশের রীতি উঠে যাওয়ায় কিছু বোঝার উপায় নেই বলে জানান বিরোধীরা।


শুধু বিরোধীরাই নন, পৃথক রেল বাজেট তুলে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও। তাঁদের মতে, রেল যোগাযোগ একটি সম্পূর্ণ আলাদা ক্ষেত্র। দেশের মোট জনসংখ্যার অধিকাংশই রেল যোগাযোগের উপর নির্ভরশীল। তাই রেলের উন্নয়ন, নিরাপত্তায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পৃথক বাজেট পেশ হলে রেল নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা এবং কাজের রেকর্ড সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা মেলে, সুযোগ থাকে সমালোচনারও। পৃথক বাজেট উঠে যাওয়ায় তার আর অবকাশ নেই বলে মত অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।



রেলের পরিকাঠামো, নিরাপত্তা ব্যবস্থা যখন তথৈবচ, 'বন্দেভারত', 'নমোভারত', বুলেট ট্রেন নিয়ে মাতামাতিতও আপত্তি শোনা গিয়েছে। প্রত্যেক 'বন্দেভারত' ট্রেন তৈরিতে ১১৫ কোটি টাকা, তার বিজ্ঞাপনে আলাদা খরচ না করে সেই টাকা রেলের সামগ্রিক উন্নয়নের কাজে লাগানো যেত কি না, একাধিক বার উঠেছে সেই প্রশ্ন। গতবছর কেন্দ্রীয় বাজেটে রেলের জন্য ২.৪ লক্ষ কোটি বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই নিয়ে প্রশ্ন করলে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব জানান, ওই টাকা 'বন্দেভারত' তৈরির কাজে গতি আনতে ব্যবহৃত হবে। ২০১৯-'২০ সালে সাধারণ ট্রেনের যাত্রীসংখ্যা ছিল ৮০৮ কোটি। তাই সামগ্রিক পরিষেবাকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র 'বন্দেভারতে'র উপর কেন জোর দেওয়া হচ্ছে, সেই সময়ই প্রশ্ন ওঠে।



কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার পর আবারও সেই প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল সাংসদ জহর সরকার। তাঁর কথায়, 'সিগনাল প্রযুক্তি এতবার ফেল হচ্ছে কেন? সাধারণ নাগরিকরা যে এক্সপ্রেস ট্রেনে চাপেন, কেন তাকে হেলাফেলা করা হচ্ছে? যেভাবে দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে, বন্দেভারত বুলেট ট্রেনকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে কেন'? কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গাঁধীর বক্তব্য, 'গত ১০ বছরে যে হারে ট্রেন দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে, তা মোদি সরকারের অব্যবস্থা এবং গাফিলতিরই নিদর্শন। এর ফলে লাগাতার যাত্রীদের প্রাণহানি হচ্ছে, ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে জিনিসপত্রের'।


যদিও বিরোধীদের অভিযোগ আমল দিতে নারাজ সদ্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়া সুকান্ত মজুমদার। তাঁর কথায়, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্ঘটনা প্রতিরোধী যন্ত্র নিয়ে কতটা জানেন, সেটা আমার জানা নেই। উনি রেলমন্ত্রী ছিলেন, হয়ত জেনে থাকবেন। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, ওটা গলায় পরার মাদুলি নয়। জটিল প্রযুক্তি, আর আমাদের এত বড় দেশ। এর জন্য সময় লাগে, টাকা লাগে।" ট্রেন দুর্ঘটনা নিয়ে বিরোধীরা রাজনীতি করছেন বলেও অভিযোগ করেন সুকান্ত।


সরকারি অব্যবস্থা এবং গাফিলতির কথা বলতে গিয়ে তাই 'কবচ' প্রকল্পের উদাহরণ টানছেন বিরোধীরা। ২০২২ সালের বাজেট প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনও শুনিয়েছিলেন রেলের 'কবচ' প্রকল্পের কথা। কিন্তু বার বার ফলাও করে কবচের কথা বলা হলেও, তার বাস্তবায়ন চোখে পড়ছে না। ভারতের প্রায় ৬৮ হাজার কিলোমিটার রেলপথের মধ্য়ে এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র দক্ষিণ-মধ্য রেলের ১ হাজার ৪৬৫ কিলোমিটার রেলপথ এবং ১৩৯টি ইঞ্জিনকে কবচের আওতায় আনা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত যার মধ্যে নেই বাংলা।



২০০১ সালে মমতা রেলমন্ত্রী থাকাকালীন এই 'কবচ' প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিতি ঘটে। তখন শুধুমাত্র লোকোতেই 'অ্য়ান্টি কলিশন ডিভাইস' বসানোর কথা বলা হয়।  ২০২০-র পর নতুন নামকরণ করা হয় 'কবচ'। 'কবচ' এমন এক প্রযুক্তি, যা দু'টি ট্রেনের সংঘর্ষ আটকাতে সক্ষম। একই লাইনের ওপর দুটি ট্রেনের উপস্থিতি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকেই বুঝতে পারে ‘কবচ’। সেই অনুযায়ী আগেভাগে ট্রেনের চালককে সতর্ক করে দেয় এই প্রযুক্তি। ইঞ্জিনে বসানো যন্ত্রের মাধ্যমে অনবরত সিগন্যাল দিতে থাকে ‘কবচ’, যা চালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই প্রযুক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেনের গতিবেগও কমিয়ে দেয়।

২০১৬ সালে মোদি সরকারের রেলমন্ত্রী থাকাকালীন সুরেশ প্রভু রেল বাজেটে ট্রেন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে একটি বিশেষ অভিযান চালানোর জন্য 'মিশন জিরো অ্যাক্সিডেন্ট' চালু করেছিলেন। রেলের সুরক্ষায় তৈরি হওয়া তহবিলে ৫ বছরে ১ লক্ষ কোটি টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রাজ্যসভায় অশ্বিনী দাবি করেছিলেন, দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ১ হাজার ৪৪৫ রুটে ইতিমধ্যে পর্যায়ক্রমে ‘কবচ’ কার্যকর হয়েছে। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা আবার চরম বাস্তব সামনে এনে দিল।


আরও পড়ুন: Train Accidents in Recent Times: স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে কখনও, কখনও হুড়মুডিয়ে এসে চাপা দিয়েছে, একদশকে পর পর ট্রেন দুর্ঘটনায় হত বহু