নয়াদিল্লি: যত্নশীল, সংবেদনশীল, প্রেমিক, মিষ্টভাষী- নিজেদের সঙ্গীদের মধ্যে এমন নানা গুণ খুঁজে পেতে চাই আমরা। অনলাইন ডেটিংয়ের দৌলতে এখন এমন সঙ্গীর খোঁজ পাওয়া বিশেষ কঠিন নয়। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে এমন কাউকে যখন আপনি খুঁজে পাবেন, তখন একটা প্রশ্ন বারবার উঠে আসবে। এটা কি রূপকথার গল্পের মতো জীবন হতে চলেছে? না কি ভয়ঙ্কর কোনও পরিণতি অপেক্ষা করতে চলেছে? ফোনে কতটা কথা বললে তা সীমা পেরোবে? কখন যত্ন নেওয়া অবসেশনে পরিণত হয়? কখন আগলে রাখা দমিয়ে রাখায় পরিণত হয়? এমন একজন ব্যক্তি যিনি ঠান্ডা মাথায় এমন খুন করতে সক্ষম তাঁর মাথায় ঠিক কী চিন্তা চলে, সেটাই বুঝিয়েছেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট শ্বেতা শর্মা। শ্রদ্ধা খুনকাণ্ডের তদন্ত যত এগোচ্ছে ততই যেন আমাদের শিরদাঁড়া বেয়ে কাঁপুনি ধরাচ্ছে। এই ধরনের মানুষকে চেনা যাবে কীভাবে? সেটা বুঝতে পারা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের মুখোশের আড়ালে কীভাবে এই বর্বরতা লুকিয়ে রাখে কেউ? সেটা জানা সবার আগে প্রয়োজন।


যেহেতু এখনও তদন্ত চলছে। যেহেতু আফতাবের এখনও কোনও মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হয়নি। সেক্ষেত্রে একেবারে নিশ্চিত করে তার কী সমস্যা রয়েছে তা বলা যায় না। তবে কিছু কিছু ঘটনা এখনও যা জানা গিয়েছে তাতে কিছু কিছু মনোবৈজ্ঞানিক বলছেন যে আফতাব সাইকোপ্যাথ হলেও হতে পারে, তবে এখনও নিশ্চিত কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। 


কী ছিল ভাবনায়?
সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সহজেই ছড়িয়ে গিয়েছে এই খুনের ঘটনার খবর। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় দিনরাত আলোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন টিভির চ্যানেলে এই ঘটনা সংক্রান্ত নানা গ্রাফিক আর্ট দেখানো হচ্ছে। আর এই সময়েই একটি প্রশ্ন বারবার সবার মনে উঁকি দিচ্ছে। যে ব্যক্তি এমন নৃশংস কাজ করতে পারে, তাঁর মাথার ভিতরে তখন কী চলছিল। গ্রাফিক্সে ঘটনার বিবরণ দেখেই যে কোনও দর্শকের মনে ভয় তৈরি হচ্ছে। আর যখন সামনাসামনি এমন ঘটনা ঘটিয়েছিল তখন খুনির মনেও কি ভয় হয়েছিল? উত্তরটা-- না। মনোবিদ শ্বেতা শর্মা বলছেন, দমন করার যে চিন্তাভাবনা ছিল খুনির, সেটা আসলে কোনওকিছু সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করার একটা মানসিকতা। তিন বলছেন, 'কোনও অনুশোচনা নেই। এটা একধরনের বিকৃত আনন্দ'। কিন্তু যে মারা গিয়েছে তাকে নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গ কীভাবে আসবে? বিষয়টি একটু জটিল। মনোবিদ জানাচ্ছেন, এই সময়ে ওই ব্যক্তি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের একটা স্বাদ পায়। তিনি বলছেন, 'ওই ব্যক্তি মারা গিয়েছেন, চুপ হয়ে গিয়েছেন, এতেই আনন্দ পায় খুনি। আর কোনও বিষয় এখানে নেই। আগে ওই ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণে ছিল না। সে তর্ক করতে পারত। কিন্তু এখন তার সেই ক্ষমতা নেই, চুপ করে রয়েছে এতেই স্বস্তি পায় খুনি।'


এমন নৃশংসতা কেন?
আফতাব কি সবসময়েই খুন করতে চেয়েছিল? খুন করার ইচ্ছে কি তার আগে কখনও হয়েছিল? সেই সময় হয়তো তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল, পরে আর তা সম্ভব হয়নি। এই খুন নিয়ে কি কোনও ফ্যান্টাসি ছিল আফতাবের? খুনি অবশ্য কল্পনা করেছিল, বলছেন মনোবিদ। কারণ এই ধরনের মানুষের জন্য সেই স্তরে যাওয়া সম্ভব যখন তারা নিজের মনে মনেই ভাবতে পারেন যে 'আমি মারতে পারি। আমি মারবই।' শ্বেতা বলছেন, খুন করা বা এমন ধরনের গুরুতর কোনও কিছু করার ভাবনা এই ধরনের মানুষের সাধারণ চিন্তাভাবনার মধ্যেই পড়ে। শ্বেতা বলছেন, 'এমন অসামাজিক ব্যক্তিত্বদের (Anti-Social Personalities) মধ্যে ঝুঁকি নেওয়ার বিষয়টি সাধারণত দেখা যায়। অ্যান্টি সোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার-এর একটি অন্যতম ফ্যাক্টর এটি। পুলিশের কাছে যেখানে ভয়ডরহীনভাবে নিজের কৃতকর্মের কথা স্বীকার করেছে খুনি, তাতেই এর কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। সে নিজেই খুনের জায়গায় পুলিশকে নিয়ে গিয়েছে। কোনও সামাজিক নিয়ম মানার ক্ষেত্রে কোনও ভয়, কোনও অনুশোচনা বা কোনও মানসিক বাধা সে অনুভব করেনি। যখন কেউ যন্ত্রণায় থাকে তখন তারা আনন্দ অনুভব করে। যতদিন তাদের অপরাধ নজরে পড়ে না, ততদিন তাদের আত্মবিশ্বাস ক্রমশ বাড়তে থাকে। এই ক্ষেত্রে খুনের ঘটনার ছয় মাস পরে আফতাবকে ধরা গিয়েছে। এরমধ্যে যে ঘরে এই ভয়ঙ্কর অপরাধ সে ঘটিয়েছিল, সেই ঘরেই অন্য় একজন মেয়েকে সে ডেকেছিল।'


আগে থেকে চেনা সম্ভব?
এমন ব্যক্তিত্বকে আগে থেকে চিনতে গেলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আরও বেশি খোলামেলা আলোচনা প্রয়োজন বলে জানাচ্ছে মনোবিদ শ্বেতা শর্মা। তিনি জানাচ্ছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ঘটনার সূত্র খুঁজতে গেলে বেরিয়ে আসে ছোটবেলার কোনও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা বা কোনও ট্রমার ঘটনা। এখনও সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করার ক্ষেত্রে অস্বস্তি রয়েছে। এই কারণেই এমন সমস্যা রয়েছে এমন অনেকে নিজেদের দুর্বল ভাবে। এই মানসিক অবস্থা থেকেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে ওই ব্যক্তিরা তাদের থেকে দুর্বল মনে যাদের মনে করে তাঁদের সহজ লক্ষ্য বলে ভেবে নেয়। মনোবিদ শ্বেতা শর্মা বলছেন, 'এই সময় ওই ব্যক্তিরা মনে করে আমরা যখন দুর্বল ছিলাম তখন আমার সঙ্গে এমন এমন ঘটনা ঘটেছিল, ফলে যে আমার থেকে দুর্বল তার সঙ্গে এমন করা ঠিক।' সামান্য সময়ের দেখাসাক্ষাৎ-এ বা কথাবার্তায় এমন কোনও ব্যক্তিকে চিনে ফেলা খুবই কঠিন বলে সতর্ক করেছেন মনোবিদ।


তবুও কতটা সম্ভব?
সাধারণ কোনও মানুষের পক্ষে এমন ব্যক্তিকে চিনে ফেলা সম্ভব নয় বলেই জানিয়েছেন মনোবিদ শ্বেতা শর্মা। তবে তিনি জানান, কোনও বিশেষজ্ঞ অনেকসময় বুঝতে পারেন বিষয়টি। অনেক ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির কারও মতামত বা সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার বা নিয়ন্ত্রিত করার ইচ্ছে বা চেষ্টা দেখা যায়। বা সময়ে সময়ে মিথ্যে বা ভুল কথা বলার প্রবণতা দেখা যায়। মনোবিদ জানাচ্ছেন, অনেক সময় এই ব্যক্তিরা দেখনদারিতে বিশ্বাস করে কারণ তাঁরা সবসময় নিজেদের আসল ব্যক্তিত্বকে লুকোতে চায়। সেই কাজ করতে গিয়েই অতিরিক্ত মিষ্টভাষী বা নরম স্বভাবের বলে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে চায়। এর ফলে সহজেই অনেকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকেন। কোনও সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রথম দিকে তাঁদের কথা-ব্যবহার অনেক বেশি রোমান্টিক হতে পারে। সবসময় ফোনে কথা বলা, সবসময় যোগাযোগে থাকা, অনেক বেশি সমর্পণের পরিস্থিতি দেখা যায়। মনোবিদ শ্বেতা শর্মা জানাচ্ছেন, এই বিষয়গুলি লক্ষ্য করা প্রয়োজন কারণ কোনওকিছুই অতিরিক্ত ভাল নয়। সবক্ষেত্রেই একটি ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। এই ধরনের ব্যক্তিরা সম্পর্কের ওঠানামার সময় অনেকবেশি মারাত্মক হয়ে ওঠেন। প্রথম দিকের সময় কেটে গেলে এরা কোনও সম্পর্কের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলতে পারে। কখনও যদি তারা মনে করে, উল্টোদিকের মানুষটি তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে তখনই তাদের আসল ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়।


পরিকল্পনা করেই খুন?
শ্বেতা শর্মা বলছেন, 'এটা রাগের মাথায় করে ফেলা খুন নয়। কোথায় দেহাংশ ফেলা হবে তা আগে থেকে পরিকল্পনা করা হয়েছে। ও জানত কীভাবে দেহ কাটতে হবে। তার জন্য় পড়াশোনা করেছে। গোটা বিষয়টা অভিযুক্তের মাথায় ছিল। ঝামেলায় সময় বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওই মহিলাকে নিয়ে এসে তারপর খুন করা হয়েছে। তারপর পরিকল্পনা করেই গোটা কাজটা করা হয়েছে। যদি রাগের মাথায় খুন করে থাকত তাহলে কোনওভাবে দেহ ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করত। কিন্ত এটা গুরুতর কোনও খুনির মাথার কাজ। গোটা বিষয়টাই তার মাথায় ছিল। ও জানত ও এটা করতে পারবে এবং মেয়েটি যে ওর নিয়ন্ত্রণে ছিল সেটাও ও জানত।'      


লক্ষণগুলি নিয়ে কথা বলার সময় শ্বেতা শর্মা জানিয়েছেন, মানসিক স্বাস্থ্য় নিয়ে কথা বলা অনেক বেশি জরুরি। যাঁরা কোনওরকম সমস্যায় ভুগছেন তাঁদের দুর্বল বলে চিহ্নিত করে দূরে না ঠেলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। তাঁর মতে, চেপে রাখা অনুভূতি পরে  হিংসাত্মক হয়ে এক বা একাধিকজনের জন্য ভয়ঙ্কর হতে পারে। আগে থেকে সতর্ক হয়ে পদক্ষেপ করলে সহজেই এমন সমস্যার চিকিৎসা সম্ভব এবং ভবিষ্যতে এমন ধরনের অপরাধ রোখা সম্ভব। 



আরও পড়ুন:  প্রেমিকাকে ৩৫ টুকরো, ৬ মাস পরে পুলিশের জালে প্রেমিক, দিল্লির ঘটনায় তোলপাড়