পার্থপ্রতিম ঘোষ, ঋত্বিক মণ্ডল ও সন্দীপ সমাদ্দার, কলকাতা: একজন নয়, ঘুষের বিনিময়ে চাকরির টোপ দেওয়ার চক্রে একাধিক ব্যক্তি। শুভেন্দু অধিকারীর ঘনিষ্ঠ রাখাল বেরাকে দফায় দফায় জেরায় উঠে এসেছে এমনই তথ্য, দাবি পুলিশ সূত্রে। পলাতক এই মামলায় অপর এক অভিযুক্ত সেচ দফতরের প্রাক্তন কর্মী চঞ্চল নন্দী। রাখালকে জেরা করে কাঁথির বাসিন্দা চঞ্চল নন্দীর খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ।
শুভেন্দু অনুগামী বলে রাখালকে ফাঁসানো হচ্ছে, দাবি আইনজীবীর। ফাঁসানোর প্রশ্নই ওঠে না, পাল্টা দাবি কুণাল ঘোষের।
সেচ দফতরে চাকরি দেওয়ার নামে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার। তাতেও জড়িয়ে গেল রাজনীতি! গতকাল রাতে মানিকতলার আবাসন থেকে রাখাল বেরা নামে এই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ধৃত ব্যক্তি বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। আর এখানেই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে রাজনীতি! ধৃতের আইনজীবী কল্লোল দাসের অভিযোগ, শুভেন্দু ঘনিষ্ঠ বলেই রাখালকে গ্রেফতার করেছে তৃণমূল সরকারের পুলিশ। যদিও তা মানতে নারাজ শাসকদল। তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের পাল্টা দাবি, ‘কোনও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঘটনা ঘটেনি। যখন অভিযোগ তখন তো গ্রেফতার করবেই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ওটা, ৫ বছর তদন্ত হওয়ার পর যখন চার্জশিট পেশের দিন চারজনকে গ্রেফতার করা হল।’ বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ আবার বলেছেন, ‘কার ঘনিষ্ঠ জানি না, শুভেন্দু যেহেতু এখন তৃণমূলে নেই। ওদের কোথাও তো নাকি দুর্নীতি হয় না। এখন মুখ্যমন্ত্রী বলছেন টাকা নেওয়া চলবে না। তার মানে উনি স্বীকার করে নিচ্ছেন, এতদিন টাকা নিতেন।’
পুলিশ সূত্রে খবর, উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগরের বাসিন্দা সুজিত দে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মানিকতলা থানায় অভিযোগ দায়ের করে জানান, রাখাল, চঞ্চল-সহ আরও কয়েকজন সেচ দফতরের গ্রুপ-ডি পদে চাকরি দেওয়ার নামে ২ লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন। যে রাখাল বেরা, বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। পুলিশ সূত্রে খবর, দিঘায় রাখালের হোটেল রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে অন্যান্য ব্যবসা। অপর অভিযুক্ত চঞ্চল সেচ দফতরের প্রাক্তন কর্মী। তাঁর বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে। বর্তমানে পুলিশের খাতায় তিনি পলাতক।
ইয়াসের পর থেকে লাগাতার মুখ্যমন্ত্রীর নিশানায় বিগত দিনে সেচ দফতর ও বন দফতরের কাজ। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত রাজ্যের সেচমন্ত্রী ছিলেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর ২০১৯-এ শুভেন্দুকে সেচ দফতরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দু’জনই এখন বিজেপিতে। নাম না করে তাঁদের নিশানা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘টাকা ঠিকমতো ব্যবহার করা উচিত। সেটা ঠিক মতো হয়নি। আমাদের টাকা অপচয় করা হচ্ছে। প্রত্যেক বছর বাঁধ সারালেও কেন তা ভেঙে যাচ্ছে? লাখ লাখ টাকা জলে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনা উচিত। আমফানের সময় প্রচুর গাছ ভেঙেছে। সেই গাছ কোথায়?’
এই প্রেক্ষাপটেই ইয়াসের পর একের পর বাঁধ ভাঙা নিয়ে তদন্তের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘সব অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। সবকিছুর তদন্ত হবে। মানুষের জীবন সবার আগেষ। কাউকে রেয়াত করা হবে না।’
এর ফলে প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি সেচ দফতর ও বন দফতরের কাজ নিয়ে বারবার ক্ষোভপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে কি আসলে শুভেন্দু ও রাজীবকে নিশানা করা হচ্ছে?
শুভেন্দুর অবশ্য পাল্টা দাবি, ‘তদন্ত করে দেখুক না। তাহলেই বোঝা যাবে। আমি কয়েকমাসের জন্য সেচমন্ত্রী হয়েছিলাম। তারপর লকডাউন জারি হয়। কোনও ফাইলে আমার সই নেই। কোনও মন্ত্রীকে কাজ করতে দেন না মুখ্যমন্ত্রী।’
রাজ্য বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যও তৃণমূলকে আক্রমণ করে বলেছেন, ‘নিজেদের মুখ লুকোতেই এখন এসব কথা বলছে। দুয়ারে জল, তাই দুয়ারে যেতে পারছে না। মুখ লুকোতে কিছু তো বলতে হবে, তাই এসব কথা বলছে।’
আমফান থেকে শিক্ষা নিয়ে সুন্দরবনে ৫ কোটি ম্যানগ্রোভ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য বন দফতর। গত মাসেই সেই কাজ শেষ হয়েছে বলে সূত্রের খবর। তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘটনাচক্রে আমফানের সময় রাজ্যের বনমন্ত্রী ছিলেন রাজীব। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘কোথায় গেল ম্যানগ্রোভ? এত গাছ পড়ল, কোথায় গেল সেইসব গাছ? ৩ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দাও।’
পাল্টা শমীক বলেছেন, ‘এগুলো অবশ্যই খতিয়ে দেখা উচিত। দুর্নীতি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী তো দায় এড়াতে পারেন না।’
বাঁধ ভাঙার কারণ থেকে শুরু করে থেকে কোথায় গেল ম্যানগ্রোভ? এসবের তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর কি রাজ্য রাজনীতিতে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে? তৃণমূলের সঙ্গে তৃণমূলত্যাগীদের সংঘাত কি আরও জোরাল হবে? রাজনৈতিক মহলে এই প্রশ্নগুলি জোরাল হচ্ছে। রাখালের গ্রেফতারি তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। বিজেপি অবশ্য এক অন্তত প্রকাশ্যে গুরুত্ব দিতে নারাজ।