মন্দারমণি: ইয়াস চলে গিয়েছে, তবু দুর্যোগ যেন কাটছেই না দিঘা-মন্দারমণিতে। অথৈ জলের ধারে বাস, অথচ এক ফোঁটা পরিশ্রুত পানীয় জল নেই। গ্রামের নাম পুরুষোত্তমপুর। মন্দারমণি ব্লকের অন্তর্গত এই গ্রামে কম করে বারোশো পরিবারের বাস। আর সেখানেই প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রোষ তৃষ্ণা মেটানোর জলটুকুও কেড়ে নিয়েছে। এলাকায় পানীয় জলের একমাত্র অবলম্বন টিউবওয়েল অনেকক্ষণ টিপলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে নোনা জল। তার সঙ্গে নোংরা। তেষ্টা মেটাতে বাধ্য হয়ে সেই জলই খাচ্ছেন স্থানীয়রা।
ইয়াস বিপর্যয়ের পর থেকেই বিধ্বস্ত মন্দারমণির পুরুষোত্তমপুর গ্রাম। দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে কার্যত গলা শুকিয়ে আসার মতো অবস্থা। বুধবারের পর আজ শনিবার অবশেষে সরকারি উদ্যোগে প্রথম পানীয় জল পৌঁছল সেখানে।
মন্দারমণি নামটা শুনলেই চোখের সামনে যে সৈকত সুন্দরীর ছবিটা ভেসে ওঠে, ২৬ মে তা তছনছ করে দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। বাঙালির অন্যতম প্রিয় বেলাভূমি জুড়ে এখন শুধুই ধ্বংসের চিহ্ন। উপকূলের গণ্ডি ছাড়িয়ে সেই ক্ষতর শিকড় পৌঁছে গিয়েছে আরও গভীরে। বাঁধ ভেঙে, বাঁধ ছাপিয়ে সমুদ্রের নোনা জল ঢুকে মন্দারমণি ব্লকে প্লাবিত বহু গ্রাম।
চারদিকে প্রচুর জল। কিন্তু গোটা গ্রামে এক ফোঁটা পানীয় জল নেই। পানীয় দলের তীব্র হাহাকার। গত ৩ দিন ধরে নোনাজল খেয়ে থাকতে হয়েছে মানুষজনকে। এক স্থানীয় বাসিন্দার কথায়, কী করব কোনও জল নেই। একটা মাত্র কল, কিন্তু তার জল মুখে দিতে পারবেন না। পুরো নোনতা। ওই বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছি। নিজেরা খাচ্ছি।
কেউ আবার বলছেন, গত ৩ দিনধরে পেটে খাবার নেই, ভাত নেই, মুড়ি খেয়ে রয়েছি। আর এই নোংরা নোনা জল। কোনও রকমে ছেঁকে খাই। খারাপ জেনেও খেতে হচ্ছে
ঘূর্ণিঝড়ের ঝাপটা লন্ডভন্ড করে দিয়েছে গোটা গ্রামকে। বেশিরভাগ বাড়িই ভেঙে গিয়েছে। গ্রামের মাঝখান দিয়ে যে পিচ রাস্তা গিয়েছে, জলের তোড়ে তা এখন দুভাগ। ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে মাঝের অংশ। তার ফলে ত্রাণের গাড়িও ঢুকতে পারছে না। আমাদের কিচ্ছু নেই, পরনের কাপড়ও নেই। বাচ্চার মুখে দুবেলা ভাত দিতে পারি না
যাবতীয় প্রতিকূলতার মধ্যেই শনিবার পুরুষোত্তমপুর গ্রামে নিজের টিম নিয়ে পৌঁছন মন্দারমণির ব্লক মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। কলের জল পরীক্ষা করে দেখেন তাঁরা। টিউবওয়েল খুলে তার ভিতরটা ব্লিচিং দিয়ে পরিষ্কার করেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
মন্দারমণির ব্লক মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মানস কুমার ঘোষ জানিয়েছেন, এই জল খাওয়ার উপযুক্ত না। কিন্তু সেই জলই খেতে হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি জল জীবাণুমুক্ত করতে। সেকারণেই এসেছি। পরিষ্কার করা হল। ২৪ ঘণ্টা খেতে পারবে না। তারপর আবার খাবার যোগ্য হবে।
বুধবারের বিপর্যয়ের পর শনিবারই পুরুষোত্তমপুর গ্রামে প্রথম ঢুকল পানীয় জলের একটি গাড়ি। তা সংগ্রহের জন্য ঘড়া, কলসি নিয়ে হাজির হন গ্রামবাসীরা। বারোশো পরিবারের তিনদিনের তৃষ্ণা। একটা জলের গাড়ি। সবাই চান একটু বেশি করে জল ধরে রাখতে। কিন্তু কীসে ধরবেন। বেশি বাসনকোসনও তো নেই। সেসবও ভেসে গিয়েছে জলে। পুরুষোত্তমপুর কত তাড়াতাড়ি ছন্দে ফেরে, এখন তারই লড়াই।