হাওড়া: ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের অনেকের নামই জানা যায় না। স্বাধীনতার পর অনেকেই প্রাপ্য সম্মান বা স্বীকৃতি পাননি। দেশমাতৃকার জন্য যাঁরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে এসে দেশের মানুষ তাঁদের নামটুকুও জানেন না। ‘ইতিহাসের বিরাট ট্র্যাজেডি’বোধহয় এটাই!
এমনই একজন বিস্মৃত বিপ্লবী হাওড়ার বাকসাড়া অঞ্চলের মোহিতমোহন মুখোপাধ্যায়। ১২ বছর বয়স থেকেই হাতে বোমা-গুলি নিয়ে ব্রিটিশদের দেশ থেকে তাড়ানোর লড়াইয়ে নেমে পড়েছিলেন তিনি। একাধিকবার জেল খাটতে হয়েছে। ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে বন্দি করে রেখেছিল কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেল, ঢাকার জেলে। প্রেসিডেন্সি জেল থেকে পালিয়েও গিয়েছিলেন এই বিপ্লবী। স্বাধীনতার ২৫ বছর পূর্তিতে ১৯৭২ সালের ১৫ অগাস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী তাঁকে তাম্রপত্র দিয়ে সম্মান জানান। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে সাম্মানিক পেনশনও পেতেন মোহিতমোহনবাবু। যদিও পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন, সরকারের দেওয়া ভাতা নিতে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না তিনি।
অগ্নিযুগের এই বিপ্লবীর পুত্র আশুতোষ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘আমার বাবার জন্ম ১৯১৪ সালে। ৬ বছর বয়সেই তিনি বাবা-মাকে হারান। উত্তরপাড়ায় পিসির বাড়ি ছিল। বাবা-মাকে হারানোর পর তিনি সেখানেই চলে যান। পড়াশোনায় বাবা খুব ভাল ছিলেন। তিনি ইংরাজি খুব ভাল জানতেন। উত্তরপাড়ার এক শিক্ষক বাবার পড়াশোনার দায়িত্ব নেন। তবে তিনি বাবাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নেন, দেশের জন্য কাজ করতে হবে। সেই থেকেই বাবার স্বদেশী আন্দোলন শুরু। অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন বাবা। বন্দুক চালানো, বোমা বানানো শিখে যান তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি চলতে থাকে বিপ্লব। ম্যাজিস্ট্রেট বার্জ হত্যা মামলায় বাবার নাম জড়িয়েছিল। তাঁকে প্রেসিডেন্সি জেল ও ঢাকার জেলে বন্দি করে রেখেছিল পুলিশ। প্রেসিডেন্সি জেল থেকে পরিকল্পনা করে পালিয়েছিলেন বাবা। নির্দিষ্ট দিনে প্রেসিডেন্সি জেলের বাইরে অপেক্ষা করছিল একটি গাড়ি। বাবা পাঁচিল টপকে সেই গাড়িতে উঠে পালিয়ে যান। এরপর আর তাঁকে ধরতে পারেনি পুলিশ।’
আশুতোষবাবু আরও জানিয়েছেন, ‘স্বদেশী আমলে বাবা পুলিশের নজর এড়ানোর জন্য অমল মুখোপাধ্যায় ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। তিনি গাঁধীজির অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাস করতেন না। বাবা মনে করতেন, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই স্বাধীনতা আসবে। প্রেসিডেন্সি জেলে থাকার সময় একবার নেতাজির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। নিজের কথা বলতে না চাইলেও, নেতাজির সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা সারাজীবন গর্ব করে বলতেন বাবা।’
মোহিতমোহনবাবুর পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি প্রথমে একটি প্রসাধনী সংস্থার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সেই সংস্থায় তখনও কর্মীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু হয়নি। সেই দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন এই বিপ্লবী। শেষপর্যন্ত সেই দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় সংস্থা। দাবি আদায় করে চাকরি ছেড়ে দেন মোহিতমোহনবাবু। ততদিনে তিনি বিয়ে করেছেন। আর্থিক সমস্যা দূর করার জন্য ছোটবেলার জায়গা বালি-উত্তরপাড়ায় ফিরে গিয়ে ছাত্র পড়ানো শুরু করেন তিনি। এরপর চাকরি পান বালি জুট মিলে। কিন্তু সেখানেও সমস্যা। তখন বালি জুট মিলের আধিকারিকরা প্রকাশ্যে ঘুষ নিতেন। কিন্তু লেবার অফিসার মোহিতমোহনবাবু ঘুষ নিতেন না। ফলে সহকর্মীদের বিরোধিতার মুখে পড়তে হত তাঁকে। একদিন এক ব্যক্তি তাঁকে পানের মধ্যে করে টাকা দিতে যায়। তাঁকে চড় মেরে চাকরি ছেড়ে দেন এই বিপ্লবী। এরপর আর তিনি কোনওদিন চাকরি করেননি। ১৯৮৪ সালে তিনি প্রয়াত হন।
বাংলার নানা প্রান্তে মোহিতমোহনবাবুর মতো অসংখ্য মানুষ ছিলেন। এই বিপ্লবী তবু কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, অনেকে তো সেটুকুও পাননি। স্বাধীন ভারতে অবহেলা আর অনাদর বোধহয় তাঁদের প্রাপ্য ছিল না।