হুগলি: সোমবার ডানলপ ময়দানে জনসভা থেকে সোমবার তৃণমূলকে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। ২ দিন পর, একই জায়গা থেকে জবাব দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নাম না করে মোদি-অমিত শাহকে অল-আউট আক্রমণ করলেন তৃণমূলনেত্রী।
মমতা বলেন, "এই যে সকলে বলে গেল, খেলা হবে? মা-বোনেরা খেলা হবে? ভাইয়েরা খেলা হবে? খেলা একটাই হবে একুশের সাধারণ নির্বাচনে। একদিকে সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি, একদিকে তৃণমূল। আমি গোলরক্ষক। আমি দেখতে চাই কটা গোল মারতে পারেন। একটাও মারতে পারবেন না।। বারপোস্টের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাবে।"
নাম না করে মোদিকে আক্রমণ করে বলেন, "তিনি যেখানে বক্তৃতা দেন, সেখানে ট্রান্সপারেন্ট কাচ। এটা লাগিয়ে রেখে দেন। লিখে নিয়ে আসেন। দেখে বলেন ভাল আছেন তো? আমার এখানে ট্রান্সপারেন্ট কাচ নেই। একলাইন বাংলা বলে বাংলার মন জয় করা যায় না। আমিও গুজরাতি জানি। আমি তো কাচ দেখিনি। এসব জানতে হয়।"
এখানেই থামেননি তৃণমূলনেত্রী। বলেন, "সেদিন বড় বড় কথা বলে গেলেন। এখানকার মা-বোনেরা সুরক্ষিত নয়। বিজেপির দলে মেয়েরা সুরক্ষিত তো? উত্তরপ্রদেশে সুরক্ষিত? বিহারে সুরক্ষিত? মধ্যপ্রদেশে সুরক্ষিত? সব জায়গায় অরক্ষিত না হলে কুরক্ষিত। বাংলায় মা-বোনেরা ভাল আছে।"
সোমবার একাধিক রেল ও মেট্রো প্রকল্পের সূচনা করেন নরেন্দ্র মোদি। সেই প্রসঙ্গ টেনে এদিন মমতা বলেন, "বলছে হামনে সব কর দিয়া। তারকেশ্বর লাইন কে করেছিল? বুকের পাটা থাকলে বলুন কে করেছিল। আমি রেলমন্ত্রী থাকাকালীন করে দিয়েছি। দক্ষিণেশ্বর-নোয়াপাড়া মেট্রো আমি করেছি। তুমি ফিতে কেটেছো। লজ্জাও করে না। করল কে? দিল কে? লড়ল কে?"
নাম না করে মোদি-অমিত শাহকে হোঁদল কুতকুত ও কিম্ভূত কিমাকার বলে কটাক্ষ করেন মমতা। বলেন, "দেশের প্রধানমন্ত্রী মিথ্যে বলছে। আমি প্রধানমন্ত্রী পদটাকে সম্মান করি। আজ আছেন, কাল থাকবেন না। এই দেশে দু’টো নেতা। একটা হচ্ছে হোঁদল কুতকুত। এর ইংরেজি, হিন্দি কী জানি না। ক্লাসিকাল বাংলা শব্দ। আরেকটা কিম্ভূত কিমাকার।"
কয়লাপাচার নিয়ে অভিষেক-পত্নীকে সিবিআইয়ের জেরা নিয়ে মমতার আক্রমণ, "আমার ওপর খুব রাগ। আমায় কী করতে পারেন? মারতে পারেন, খুন করতে পারেন। মা-বোনেদের অসম্মান করতে পারেন? বাড়িতে ঢুকে বাচ্চা মেয়ে, বউ, তাকে কয়লাচোর বলছেন? কয়লাচোরদের নিয়ে নিজে কোলে তুলে বেড়াচ্ছেন। আমাদের ঘরের মা-বোনেরা কয়লা চোর? এত বড় সাহস, মা-বোনেদের কয়লা চোর বলছেন। কয়লা চোরদের হোটেলে থাকছেন। আপনার সারা গায়ে ময়লা লেগে আছে। আপনাদের চরিত্র সোনা-রুপোয় বাঁধিয়ে দিতে হয়। কী ভাবেন, কেস জানি না? সব জানি। খারাপ কথাটা খারাপ ভাষায় বলতে জানি না। লাগাম রাখতে হয়। "
বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারকে দাঙ্গাবাজ ও ধান্দাবাজ বলবে কটাক্ষ করেন তৃণমূলনেত্রী। বলেন, "কথায় কথায় বলেন, তৃণমূল তোলাবাজ। আপনি সবথেকে বড় দাঙ্গাবাজ। ধান্দাবাজ। ৫-১০ টাকা তুললে তাকে তোলাবাজ বলে। যাঁরা কোটি কোটি টাকা তোলেন? দেশ কে দেশ বিক্রি করে দেন। কাটমানি খান। তাঁরা কি ক্যাটমানি খান না র্যাটমানি? নেংটি ইঁদুরের দল সব। বড় বড় কথা।"
অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ ও দেবলীনা দত্ত ইস্যুতে সরব হন মমতা। বলেন, "সায়নী মেয়েটা দু’টো ট্যুইট করেছে। তাঁকে থ্রেট করেছে। যা তা ভাষায় আক্রমণ করেছে। কথা বলেছে। তাই নিয়ে তাঁকে ও দেবলীনাকে কী অপমানটাই না করেছে। আমরা তো মায়েদের কোলে থাকি। মায়ের আশীর্বাদ আমার আশীর্বাদ। আজ বিজেপি দলের মেয়েদের নিয়ে একটার পর একটা স্টোরি বললে, লজ্জায় শিহরিত হতে হয়। ওই দলে মেয়েরা সুরক্ষিত নয়। অনেকে মুখ বুজে বসে আছে। বলতে পারছে না। আমাদের দলে নারীদের সম্মান করা হয়। মাকে যেভাবে সম্মান করি। কাউকে করি না।"
রাজ্য সরকারের প্রকল্পের কথা স্মরণ করিয়ে এদিন কেন্দ্রকে তুমুল আক্রমণ করেন মমতা। বলেন, "বলছে মমতা কিছু করেনি। কন্যাশ্রী কে করেছে? ঘরে ঘরে মেয়েরা পড়াশোনা করছে। শিক্ষাশ্রী কে করেছে? ঐক্যশ্রী কে করেছে। সবুজশ্রী কে করেছে? ট্যাব কে দিয়েছে? বিনা পয়সায় রেশন কে দিচ্ছে? স্বাস্থ্যসাথী কে দিচ্ছে? রূপশ্রী কে দিয়েছে? সমব্যথী কে দিয়েছে? মোদি বাবু কী দিয়েছে? ডুগডুগি? রোজ ডুগডুগি বাজাচ্ছে।"
বিজেপির বিরুদ্ধে ভুয়ো ভিডিও ও সিনেমা তৈরি করে মিথ্যে ছড়ানোর অভিযোগ তোলেন মমতা। বলেন, "ফেক ভিডিও তৈরি করছে, ফেক সিনেমা তৈরি করছে। মানুষকে মিথ্যে বলছে। মিথ্যেবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। হুগলিতে রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম। একদিকে ব্যান্ডেল চার্চ, অন্যদিকে মাহেশের রথ, অন্যদিকে ফুরফুরা শরিফ।"
মমতার দাবি, তৃণমূলকে আটকাতে আজ বাকিরা একজোট হয়েছে। তিনি বলেন, "আজ আবার সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি এক হয়েছে। জিতবে না। মিথ্যে বলছে। পলিটিক্যালি ফাইট করলে প্রতিহিংসা কেন। তৃণমূলে বিশ লক্ষ ওয়ার্কার আছে। সবাইকে অ্যারেস্ট করে জেলে রাখো। তৃণমূল এমন দল, আদি সপ্তগ্রামে পুঁতলে দিল্লিতে মাথা তুলে দাঁড়াব। সুস্থ বাঘের থেকে আহত বাঘ ভয়ঙ্কর।"
ভোটের আবহে বাংলায় তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করা খেলা হবে স্লোগানও শোনা যায় তৃণমূলনেত্রীর কথায়। বলেন, "খেলা তো হবেই রে। খেলা তো হবেই। এই খেলা থেকেই বিজেপিকে ঠিক করতে হবে, আগামী দিনে দেশে থাকবে কি থাকবে না। বাংলায় হারালে দেশ থেকে বিদায় নেবে।"
মোদি-অমিত শাহকে ফের নাম না করে দৈত্য ও দানব বলে কটাক্ষ করেন তৃণমূলনেত্রী। বলেন, "একটা পার্টি। একজন দানব, আরেকজন দৈত্য। একজন রাবণ, আরেকজন দানব। গায়ের জোর। আর খুচরো চুনো পুঁটির দল। বড্ড বেশি কথা বলছে। দুটো মাস সহ্য করতে হবে। তারপর দেখব কার কত জোর। পেশিবল নয়, গণতন্ত্রের জোর। "
বহিরাগত ইস্যুতে বিজেপিকে একহাত নেন মমতা। বলেন, "আপনার এলাকায় গুণ্ডা ঢুকিয়ে দেবে। আপনার এলাকা বহিরাগতরা দখল করে নেবে। বাংলাটাকে বাইরের গুণ্ডা দিয়ে দখল করে নেবে। বাংলা চান? না বাংলাকে বিক্রি করে দেবে, সেটা চান? যদি বাংলা চান, তাহলে পরিষ্কার শুনে রাখুন। বাঙ্গাল নয়, বাংলা চাই। গুজরাত বাংলা শাসন করবে না। মোদি বাংলা শাসন করবে না। কারও চোখ কাটা, কারও কান কাটা। দুর্গাপুরের হোটেল ভাড়া নিয়েছে। কে ভাড়া নিয়েছে? নাম বলব? ফাইভ স্টার হোটেল থেকে পার্টি চলছে। সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ পার্টি।"
ভোটের পর তৃণমূলের নেতাদের জেলে ঠাঁই হবে বলে আক্রমণ শানাচ্ছে বিজেপি। এদিন জবাবে মমতা বলেন, "আমাকে ধমকানোর চেষ্টা করছে। করে দেখো। খেলে দেখো। কজনকে গ্রেফতার করবে? জেল ফুটো হয়ে বেরিয়ে আসবে। আগেরবার আদিসপ্তগ্রামে ভোট পাইনি। নিশ্চয় আমাদের ভুলত্রুটি হয়েছে। বলাগড়ে পাইনি। নিশ্চয় ত্রুটি হয়েছে। শুধরে নিয়েছি। বিজেপির মতো পার্টিকে আর ডেকে আনবেন না। সিপিএম-কংগ্রেসের কথা শুনবেন না। ফানুসটাকে বাড়তে দেবেন না।"
ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির তুলনা টেনে আনেন মমতা। বলেন, "এত ভাঁওতাবাজ, এত দাঙ্গাবাজ পলিটিক্যাল পার্টি সারা পৃথিবীতে কোথাও নেই। ট্রাম্পকে দেখেছিলেন তো? তাঁকে জেতাতে গেছিল।। ট্রাম্পের যা হাল হয়েছে, তার থেকেও খারাপ হবে। যেখানে দাঁড়িয়ে মিটিং করে মিথ্যে বলে গেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে বলে গেলাম, ক্যাট পার্টি এখন র্যাট পার্টি হয়েছে। গরিব খেলে তোলাবাজ। কোটিপতিকে টাকা দিলে? কৃষকের তো লোন শোধ হয় না। দুজন শিল্পপতির ঋণ শোধ হয়েছে। আপনারা কি ওয়াশিং মেশিন। চোরের মায়ের বড় গলা।"
নোটবন্দির টাকা কোথায় গেল? নরেন্দ্র মোদি জবাব দাও। কোল ইন্ডিয়া বিক্রি হচ্ছে কেন? মোদি জবাব দাও। সেল বিক্রি কেন? মোদি জবাব দাও। কৃষকরা রাস্তায় কেন, মোদি জবাব দাও। এখানে ডানলপের শ্রমিক আছে? ডানলপ কেন পাঁচ বছর বন্ধ করে রেখেছেন। নিজে করেন না। আমাকেও করতে দেননি।
বিজেপির বঙ্গ-জয়ের ডাককে কটাক্ষ করে তৃণমূলনেত্রী বলেন, "বলছে বঙ্গাল লে লেঙ্গে। বাঙ্গাল লেনা ইতনা আসান নেহি। ভাবছে তা ধিন তা ধিন তা। অত সহজ নয়। মা-বোনেরা যা হয়েছে ভুলে যান। আদি সপ্তগ্রাম আমাদের দিন। গোঘাট দিন। খানাকুল দিন। আমাদের দিন। এই মাটিতে বিজেপিকে ভাল করে কবর দিন।"