উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়, বীরভূম: তারাপীঠ থেকে শুরু। শেষ কীর্ণাহার-এ। শুরু করেছিলেন জে পি নাড্ডা। শেষ করলেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। টানা ৫ দিন রথ ঘুরল বীরভূমের অলিতে-গলিতে। বিজেপির যে নেতা যখন সময় পেয়েছেন চেপে বসেছেন রথে। আর দু-দিকে তাকিয়ে হিসেব কষার চেষ্টা করেছেন পদ্ম ফোটার জমি কি আদৌ প্রস্তুত?


বিজেপির রথযাত্রার লক্ষ্য দুটো। এক, বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রচারে ঝড় তোলা। সঙ্গে সাংগঠনিক শক্তিকে আরও মজবুত করা। দুই, মানুষের মধ্যে কতটা সাড়া পড়ছে তার হিসেব কষা। যেমন বীরভূমের ক্ষেত্রে বিজেপির যে রিপোর্ট কার্ড তৈরি হবে তাতে পর্যবেক্ষকরা হয়তো লিখবেন, মিশ্র প্রতিক্রিয়া মিলেছে। বীরভূমের এমন অনেক গ্রামের উপর দিয়ে রথ গিয়েছে, যেখানে রাস্তার দু'ধারে লোক প্রায় নেই বললেই চলে। বাজার থেকে নেতারা ব্যাগ ভর্তি গাঁদা ফুল কিনে এনেও তা ছেটানোর লোক জোটেনি। আবার এমন অনেক গ্রামের মধ্য দিয়ে রথ এসেছে যেখানে এক ঘণ্টার রাস্তা যেতে সময় লেগে গেছে চার ঘণ্টা। রাস্তায় এত মানুষের ভিড়।


যেমন ধরা যাক, শুক্রবারের কথা। বোলপুর থেকে শুরু হয়েছিল রথযাত্রা। শান্তিনিকেতনকে চক্কর মেরে নানুর হয়ে কীর্ণাহারে শেষ। ২৮ কিলোমিটার পথ রথের যেতে সময় লেগে গেল পাক্কা ৪টে ঘণ্টা। রাস্তায় অপেক্ষা করেছেন মানুষ। বাইক নিয়ে রথের পেছনে ছুটেছেন যুবকরা। উড়ে এসেছে ফুল। রথ থেকে ছোড়া হয়েছে বাতাসা। আর চার ঘণ্টা ধরেই রথে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে গেছেন রূপা গাঙ্গুলী। এদিনের ভিড় রুপাকে দেখতে নাকি বিজেপি টানে? রথের ওপর দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন  বিজেপির নেতা অরবিন্দ মেননরা। 


">


এদিন যে রাস্তার উপর দিয়ে রথ গেছে, সেখানে বিজেপির সংগঠন কিন্তু যথেষ্টই দুর্বল। অধিকাংশ গ্রাম সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। তৃণমূলের শক্তিশালী ঘাঁটি। এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে রাজনৈতিক সন্ত্রাস ভয়ঙ্কর। এই অবস্থায় এদিন যা ভিড় হয়েছে তাতে বিজেপি নেতাদের খুশি হওয়ারই কথা। আবার গত লোকসভা ভোটে তুলনামূলকভাবে ভালো ফল করা দুবরাজপুর সহ বেশ কিছু অঞ্চলে জমায়েত কেন ভালো হলো না, তা নিয়ে অবশ্যই ভাবতে বসতে হবে বিজেপি নেতাদের। যদিও এই গোটা রথযাত্রাকে বিন্দুমাত্র আমল দিতে রাজি নন অনুব্রত মণ্ডলরা। তার বক্তব্য,' "রথ চড়ুক, ঘোড়া চড়ুক, গরু চড়ুক বীরভূমের কিছু যায় আসে না তাতে। এখানে বিজেপির কোন জায়গা নেই।'


বিজেপির রথ যাত্রার আরও একটা উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে। নিশ্চিত ভাবেই হিডেন এজেন্ডা, একটু গণ্ডগোল। চলন্ত রথের যা প্রচার তার থেকে অনেক বেশি প্রচারের আলোতে আসতে পারতো যদি আটকে যেত রথের চাকা। রথকে ঘিরে যদি গন্ডগোল হত,কোথাও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটত, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুতোতে টান পড়ত। তাহলে নিশ্চিত ভাবেই বাড়তি ফায়দা। যেমন, লালকৃষ্ণ আডভাণীর "রাম রথ" যে সমস্ত রাজ্যের উপর দিয়ে গিয়েছিল অধিকাংশ জায়গাতেই দাঙ্গা হয়েছিল, কোথাও কম, কোথায় ভয়ঙ্কর। এক মাস ধরে সংবাদের শিরোনামে ছিল আডবাণীর রথ। আর তার ফল, ৮ শতাংশ ভোট এক ধাক্কায় বাড়িয়ে ২৭ শতাংশ করে ফেলতে পেরেছিল বিজেপি। তাই রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাঁচ- পাঁচটি রথ। এখনও পর্যন্ত রথযাত্রা শান্তিপূর্ণ। শেষ হতে আরও দিন কুড়ি বাকি। যদি  শান্তিপূর্ণভাবে রথযাত্রা শেষ হয়, তাহলে? জয় শ্রী রাম!


লেখাটা এখানেই শেষ করা যেত। কিন্তু এদিন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি বিস্ফোরক অভিযোগ নিয়ে দুটো লাইন না লিখলেই নয়। তাঁর বক্তব্য, ' বামেদের ছাত্র-যুবদের নবান্ন অভিযানে লোক পাঠিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উদ্দেশ্য ছিল এই গন্ডগোল তৈরি করা, যাতে করে বিজেপির এই রথযাত্রাকে প্রচারের আলো থেকে দূরে সরানো যায়।' অর্থাৎ ‘ম্যান মেড’ গণ্ডগোল। রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের এই অভিযোগ যদি সত্যি ধরেও নেওয়া যায় তাহলে কি কি সিদ্ধান্তে আসতে হবে? এক, চক্রান্ত করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুই, তার বিরুদ্ধে আন্দোলন জেনেও তা সফল করতে লোক পাঠিয়েছেন তিনি নিজেই। তিন, তারপর তাদেরকে পুলিশ দিয়ে পেটানো হয়েছে। চার, পুলিশের মার খেতে হবে জেনেও তৃণমূলের সদস্যরা বাম ছাত্র-যুবদের সঙ্গে পথে হেঁটেছে।


ভাবা যায়? নবান্ন অভিযানের দিন শহরে ছিলেন অমিত শাহ। প্রথম সভা ছিল কোচবিহারে। দুপুর একটায় তাঁর যখন সমাবেশ শেষ হয়েছে তখনো শুরু হয়নি নবান্ন অভিযানের মিছিল। তাঁর গোটা বক্তৃতা ও সফর সরাসরি সম্প্রচার হয়েছে সব চ্যানেলে। তাঁর দ্বিতীয় মিটিং ছিল ঠাকুরনগরে। বিকেল সাড়ে চারটে, ততক্ষণে নবান্ন অভিযান শেষ হয়ে গিয়েছে। আহত ছাত্র-যুবরা ভর্তিও হয়ে গিয়েছে হাসপাতলে। তাহলে রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিযোগ অনুযায়ী, এত বড় চক্রান্ত করে কী লাভ হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের? প্রশ্নটা রাখা হয়েছিল তাঁরই কাছে। উত্তর দেননি তিনি। তবে সেদিন বাম ছাত্র-যুবকদের নবান্ন অভিযান-এর লোক সমাগম, অনড় মনোভাব, পুলিশের লাঠির সামনেও পালিয়ে না গিয়ে লড়াই করে যাওয়া, বিজেপি নেতাদেরও যে কিছুটা ভাবিয়ে তুলেছে তা রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট।


গত লোকসভা ভোটে অনেক ‘বাম’...‘রাম’ হয়েছিলেন। কিন্তু এবারের বিধানসভা ভোটে আবার যদি রামরা বাম হয়ে পড়েন তাহলে যে অনেক হিসেব-নিকেশ বদলে যাবে, সেটাই কি এখন বিজেপি নেতাদের চিন্তার কারণ?