উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা: রেলের কয়লাঘাট বিল্ডিংয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর উঠতে শুরু করেছে একাধিক প্রশ্ন। নিজেদের দফতরের বিরুদ্ধেই সরব অস্থায়ী দমকলকর্মীরা। বেতন থেকে অন্যান্য সুযোগ সুবিধা। সবেতেই বৈষম্যের অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা। সবার সঙ্গে কথা বলে সমস্যা মেটানো হবে। আশ্বাস দমকলমন্ত্রীর।


পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে স্ট্র্যান্ড রোডে রেলের কয়ালাঘাট বিল্ডিংয়ের একাংশ। অন্যের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে চলে গিয়েছে চার দমকলকর্মীর প্রাণ।সহকর্মীদের মর্মান্তিক পরিণতি দেখে ভেঙে পড়েন অন্য দমকলকর্মীরা। স্টিফেন কোর্ট, আমরি হাসপাতাল, নন্দরাম মার্কেট থেকে বাগরি মার্কেট কলকাতায় ঘটে গিয়েছে একের পর এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড। জীবন বাজি রেখে আগুন মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দমকলকর্মীরা। কিন্তু, অভিযোগ অগ্নিযোদ্ধাদের অবস্থার একচুলও পরিবর্তন হয়নি। বিশেষত অস্থায়ী কর্মীরা যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই রয়েছেন।


এক অস্থায়ী দমকলকর্মীর কথায়, আমরা যখন কাজে যাই তখন মাথায় থাকে না কে স্থায়ী কে অস্থায়ী, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি, যখন বিপদ হয় তখন আমাদের কেউ দেখে না ৷ কয়ালাঘাট বিল্ডিংয়ে অগ্নিকাণ্ডের জেরে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মধ্যে  অনিরুদ্ধ জানা, বিমান পুরকায়েত এবং গৌরব বেজ। চুক্তিভিত্তিক কর্মী। দমকলের ভাষায় যাঁকে বলা হয় অগজিলিয়ারি ফায়ার অপারেটর। স্থায়ীদের সঙ্গে অস্থায়ী দমকলকর্মীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অগ্নিকাণ্ডের মোকাবিলা করলেও, স্থায়ী আর অস্থায়ীদের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক।


বেতন থেকে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, সবকিছুতেই বঞ্চনার অভিযোগ। সূত্রের খবর, ২০১২ সালে দৈনিক ২৮৯ টাকা মজুরি পেতেন অস্থায় দমকলকর্মীরা। তখন মাসে ২২ দিনের কাজ মিলত। বর্তমানে তাঁদের দৈনিক ভাতা ৫৮৬ টাকা। নেই কোনও ছুটি। অর্থাত্‍ নো ওয়ার্ক নো পে। এখনও ৮৯ দিন পর চাকরি নবীকরণ হয়। নেই পেনশন বা গ্রাচ্যুইটি। আরেক অস্থায়ী দমকলকর্মীর কথায়, ‘‘জানুয়ারি থেকে ৫৮৬ টাকা করে পাচ্ছি, তার আগে আরও কম পেতাম, কিন্তু ডিএ বাড়লে আমরা তার কিছুই পাই না ৷’’


স্থায়ী দমকলকর্মীদের জন্য রয়েছে মেডিক্লেম। এছাড়া অফিসাররা আরও কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু, অস্থায়ীদের জন্য রয়েছে শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসাথী। অস্থায়ী দমকলকর্মীর কথায় ‘‘স্বাস্থ্যসাথীই পাই আমরা, কিন্তু ২০১৮ তে বাবার চিকিৎসা করাতে যাই স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড নিয়ে, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি ৷’’ অস্থায়ী দমকলকর্মীদের আরও অভিযোগ, আগে ফি বছর পোশাক, হেলমেট, গামবুট সবই মিলত। কিন্তু এখন সেসব বন্ধ। ‘‘আমাদের বলা হচ্ছে স্মার্ট থাকতে হবে, কিন্তু কোনও পোশাক দেওয়া হয় না, পকেটের পয়সা খরচ করে পোশাক তৈরি করি ৷’’


আগুনের মোকাবিলায় প্রয়োজন হয় নিয়মিত প্রশিক্ষণের। অথচ অভিযোগ,কাজে ঢোকার সময় তিন মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ব্যস এখানেই শেষ। তারপর অস্থায়ী দমকলকর্মীদের জন্যে আর তার ব্যবস্থা নেই। ফায়ার ফাইটিংয়ের পোশাকও পর্যাপ্ত নয়। এক একটি গাড়িতে এধরনের পোশাক থাকে মাত্র দুটি। আমরা নিজেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে শিখে নেওয়ার চেষ্টা করি, কোনও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই আমাদের ৷


সূত্রের খবর,২০১১ সালে শেষবার দমকল বিভাগে স্থায়ী পদে নিয়োগ হয়েছিল। এরপর থেকে সবই নিয়োগই হয়েছে অস্থায়ী পদে। প্রতিটি দমকল কেন্দ্রে ৬০ শতাংশই অস্থায়ী। দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু অবশ্য জানান, ‘‘অস্থায়ী কর্মীদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়, আগের থেকে সুযোগ বেড়েছে, এরপরও ওদের কোনও বক্তব্য থাকলে আমরা অবশ্যই ওদের কাছ থেকে জানব, সমস্যাগুলো খতিয়ে দেখছি৷’’


মন্ত্রী আশ্বাস দিচ্ছেন বটে, কিন্তু বাস্তব চিত্রই বলছে অস্থায়ী দমকলকর্মীরা কার্যত নিধিরাম সর্দার। কবে এর থেকে মুক্তি মিলবে? কবে হুঁশ ফিরবে? রেলের অফিসে ভয়াবহ আগুন আরও একবার উস্কে দিল এই প্রশ্নগুলি।