নয়াদিল্লি: রাজ্য বিধানসভায় পাস হওয়া বিল রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপাল অনির্দিষ্টকাল আটকে রাখতে পারেন কি না, সেই নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করল সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালত জানাল, রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালকে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যায় না। তবে তাঁদেরও 'যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্য়ে' কার্য সম্পাদন করতে হবে বলেও জানাল আদালত। তবে দীর্ঘ সময় বিল আটকে রাখা হলে, সেক্ষেত্রে আদালতের হস্তক্ষেপ চাওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ দেশের সর্বোচ্চ আদালত আগের রায় থেকে কিছুটা হলেও পিছু হটল। কারণ এর আগে, বিচারপতি জেপি পর্দিওয়ালা ও বিচারপতি আর মহাদেবনের বেঞ্চ জানিয়েছিল, রাজ্য বিধানসভায় পাস হওয়া বিল আটকে রাখা ‘বেআইনি’। তিনমাসের মধ্যে তা ছেড়ে দিতে হবে। তামিলনাড়ু সরকার রাজ্যপাল এন রবির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করায়, গত ১২ এপ্রিল সেই রায় দিয়েছিল আদালত। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। (Power of Governor)
বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি বিআর গাভাই নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ রাষ্ট্রপতি মুর্মুর সেই চিঠি নিয়ে শুনানি করছিল। সোমবারই প্রধান বিচারপতি হিসেবে কার্যকালের মেয়াদ শেষ হচ্ছে CJI গাভাইয়ের। তার আগে এদিন বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাঁর বেঞ্চ। অগাস্ট মাসেই এই মামলার শুনানি শুরু হয়। সেই সময় আদালত জানায়, আগের রায় পাল্টাবে না। তবে আদালত এক্ষেত্রে ‘পরামর্শদাতা’র ভূমিকা পালন করবে। এদিন আদালত জানায়, রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালের পদক্ষেপ ‘বিচারযোগ্য’ নয়, অর্থাৎ বিচারের অধীনে পড়েন না তাঁরা। (Supreme Court)
গোটা বিষয়টি নিয়ে আদালত এদিন বলে-
১) সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২০০-র আওতায় বিল ছেড়ে দেওয়া, ফেরত পাঠানোর জন্য কোনও সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যায় না। কারণ সংবিধানে বলা আছে, অর্থবিল ছাড়া রাজ্যপালের কাছে কোনও বিল পাঠালে, হয় তাঁকে সেটিতে সম্মতি জানাতে হবে, নইলে সম্মতি প্রত্যাহার করতে হবে, অন্যথায় রাষ্ট্রপতির কাছে বিবেচনার জন্য বিলটি পাঠাতে পারেন তিনি।
২) কোনও বিল যদি আটকে থাকে, সেটিকে বিধানসভায় ফেরত পাঠাতে হবে।
৩) আগের সমস্ত তর্কবিতর্ক সরিয়ে রেখে বলা যায়, রাজ্যপালের যথেষ্ট বিচক্ষণতা আছে। বিল স্বাক্ষর বা তা স্থগিত রাখার ক্ষেত্রে মন্ত্রী পরিষদের সাহায্য় বা পরামর্শ দ্বারা তাঁদের হাত বাঁধা নয়।
৪) অনুচ্ছেদ ২০০-র আওতায় কার্যসম্পাদন থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া ন্যায়সঙ্গত নয়।
৫) আদালত শুধুমাত্র ‘যুক্তিসঙ্গত সময়সীমার’ মধ্যে রাজ্যপালকে বিল নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বলতে পারে, তবে কেবলমাত্র তখনই, যদি দীর্ঘসময়ের জন্য, নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা ছাড়া, অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষ্ক্রিয়তা দেখা যায়।
৬) অনুচ্ছেদ ৩৬১-র আওতায় কার্যকালের মেয়াদ চালু থাকাকালীন গৃহীত পদক্ষেপ, ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া থেকে রক্ষাকবচ পান রাজ্যপালরা। কিন্তু ‘যুক্তিসঙ্গত সময়কালে’র মধ্যে বিল না ছাড়লে, ফেরত না পাঠালে, দীর্ঘকালীন বিলম্বের ক্ষেত্রে সেই রক্ষাকবচ কার্যকর হবে না।
৭) অনুচ্ছেদ ২০১-এর আওতায় রাষ্ট্রপতির কাজকর্ম, তাঁর সম্মতিও বিচারের আওতায় পড়ে না।
৮) রাজ্যপাল কোনও বিল বিবেচনার জন্য সংরক্ষিত রাখলেই আদালতের পরামর্শ নিতে বাধ্য নন রাষ্ট্রপতি।
রাজ্যপাল যখনই কোনও বিল বিবেচনার জন্য ট
৯) সংবিধানে কোনও বিলকে ‘সম্মতিপ্রাপ্ত মনে করার’ অনুমোদন নেই। তাই এপ্রিল মাসে পাস হওয়া ১০টি বিলের মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
১০) আর তাই কোনও বিলকে ‘সম্মতিপ্রাপ্ত বলে বিবেচিত’ ঘোষণা করতে অনুচ্ছেদ ১৪২ ব্যবহার করতে পারে না আদালত।
সাম্প্রতিক কালে বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির সঙ্গে কেন্দ্রের সংঘাত যত বেড়েছে, রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়েও ততই প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, কেরলের মতো অ-বিজেপি রাজ্যগুলিতে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কাজকর্মে হস্তক্ষেপ থেকে সমান্তরাল সরকার চালানোর অভিযোগ সামনে এসেছে লাগাতার। এমনকি নির্বাচিত সরকার দ্বারা বিধানসভায় পাস হওয়া বিল ইচ্ছাকৃত ভাবে দীর্ঘ সময় আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে।
এ নিয়ে সরাসরি আদালতের দ্বারস্থ হয় তামিলনাড়ুর এমকে স্ট্যালিন সরকার। তারা জানায়, বিধানসভায় পাস হওয়া বিল আটকে রাখছেন রাজ্যপাল এন রবি, এমনকি পুনরায় পাস করিয়ে পাঠানো হলেও, মাসের পর মাস পড়ে থাকছে বিলগুলি। সেই নিয়ে শুনানিতে বছরের গোড়ায় সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যপাল এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে বিল নিয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়। জানানো হয়, সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী, রাজ্যপাল এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা যে সীমিত, তাও স্মরণ করিয়ে দেয় আদালত। কিন্তু সেই নিয়ে আদালতকে তীব্র আক্রমণ করতে শুরু করেন বিজেপি-র নেতা থেকে মন্ত্রী-সাংসদরা। এমনকি দেশের প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকড়ও বেনজির ভাবে আক্রমণ করেন সুপ্রিম কোর্টকে। আদালতের এমন নির্দেশ দেওয়ার এক্তিয়ার আছে কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন রাষ্ট্রপতি মুর্মুও। একাধিক প্রশ্ন তুলে চিঠি দেন।