তেহরান: কটরপন্থা, মধ্যযুগীয় চিন্তা-ভাবনার বিরুদ্ধে সুর চড়ানোর সাহস দেখিয়েছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু মাহসা আমিনির গ্রেফতারি এবং মৃত্যু (পরিবারের দাবি হত্যা) প্রতিবাদের সেই সুরকে তীব্র করে তোলে। তার পর বিগত দুই মাস ধরে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছে ইরান (Iran Anti-Hijab Protests)। গোলাগুলিতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি মৃত্যুদণ্ডের সাজাও জুটেছে কারও কারও কপালে। তার পরেও ভাঁটা পড়েনি হিজাব-বিরোধী আন্দোলনে। সেই কঠোর প্রতিজ্ঞার সুফল পেলেন ইরানের নাগরিকরা। মেয়েদের আচার-আচরণে নজরদারি চালানো, শালীনতা লঙ্ঘনের দোহাই দিয়ে ইচ্ছে মতো শাস্তিপ্রদানে লিপ্ত থাকা নীতি পুলিশের অবলুপ্তি ঘটল সে দেশে (Iran Morality Police)।  


বিগত দুই মাস ধরে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছে ইরান


মাহসা আমিনির গ্রেফতারি এবং মৃত্যুর পর একটানা দুই মাস হিজাব বিরোধী আন্দোলন চলে আসছে দেশে। তাতেই শেষমেশ নীতি পুলিশের অবলুপ্তি ঘটানো হল বলে জানা যাচ্ছে। সংবাদ সংস্থা ইরানিয়ান স্টুডেন্টস নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, ইরান সরকারের তরফে নীতি পুলিশ ইউনিটের অবলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মহম্মদ জাফর মোনতাজেরি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, দেশের আইন বা বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে নীতি পুলিশের কোনও সংযোগ নেই। একটি ধর্মীয় সম্মেলন চলাকালীন নীতি পুলিশের খবরদারি নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন জাফর। সেখানেই নীতি পুলিশের অবলুপ্তির কথা জানান তিনি। কারণ জানতে চাইলে আইনের আওতায় নীতি পুলিশের বৈধতা অস্বীকার করেন।


শুধু তাই নয়, মহিলাদের হিজাবে মাথা সম্পূর্ণ ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক থাকা উচিত কিনা, তা নিয়েও দ্বিতীয় চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে জানা গিয়েছে। জাফর জানিয়েছেন, দেশের সংসদ এবং বিচারবিভাগ বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখছে। হিজাবে মাথা ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক করতে যে আইন রয়েছে, তা বদলের প্রয়োজন রয়েছে বলে প্রস্তাব এসেছে ইতিমধ্যেই। দেশের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিও তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন শনিবার। তাঁর কথা অনুযায়ী, প্রজাতান্ত্রিক এবং ইসলামিক রীতি অনুযায়ীই ইরানের সংবিধান লিপিবদ্ধ করা হয়। তবে প্রয়োজনে সংবিধানে রদবদল ঘটানো যেতেই পারে।


আরও পড়ুন: Birbhum: সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি, স্বজন পোষণের অভিযোগ, জনসংযোগে গিয়ে গ্রামবাসীদের ক্ষোভের মুখে শতাব্দী


ইরানে মহিলাদের হিজাব পরা নিয়ে কঠোর আইন বলবৎ রয়েছে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের চার বছর বছর সে দেশে হিজাব বাধ্যতামূলক হয়।  সঠিক ভাবে সেই বিধি পালন করা হচ্ছে কিনা, তার দেখভালের জন্যই নীতি পুলিশের সূচনা হয় ২০০৬ সালে। ইরানে নীতি পুলিশের পোশাকি নাম ‘গাস্ত-ই-এরশাদ’,বাংলায় তর্জমা করলে যা দাঁড়ায় আচরণ সংক্রান্ত টহলদারি। দেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদের আমলে মেয়েদের আচরণ, হিজাব পরার উপর নজরদারি চালাতেই প্রতিষ্ঠা হয় নীতি পুলিশের। তার পর থেকে একাধিক বার এই নীতি পুলিশের বিরুদ্ধে বর্বরতার অভিযোগ উঠেছে। শুরুর দিকে শুধুমাত্র সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হলেও, গ্রেফতার করে ১৫ বছর জেলবন্দি করে রাখার নিদর্শনও রয়েছে। তবে এ বছর সেপ্টেম্বরে নীতি পুলিশ সব সীমা অতিক্রম করে বলে অভিযোগ।  


চলতি বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর দাদা কিয়ারেশ আমিনির সঙ্গে শহিদ হাঘানি এক্সপ্রেস হয়ে কুর্দিস্তান থেকে তেহরান যাচ্ছিলেন ২২ বছরের মেহসা আমিনি। সেই সময় রাস্তায় নীতি পুলিশ তাঁদের গাড়ি আটকায় বলে অভিযোগ পরিবারের। মেহসার পরিবারের দাবি, হিজাবে মাথা ঢাকা ছিল মেহসার। কিন্তু নীতি পুলিশ জানায়, আলগা ভাবে হিজাব জড়িয়েছেন মেহসা। তাই গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। ডিটেনশন শিবিরে নিয়ে গিয়ে হিজাব পরার পাঠ দেওয়া হবে বলে জানায় নীতি পুলিশ। এক ঘণ্টার মধ্যে মেহসাকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলেও জানায়। কিন্তু পরে কাসরা হাসপাতালে মেহসার খোঁজ মেলে বলে অভিযোগ পরিবারের। মেহসার পরিবার জানিয়েছে, হাসপাতালে ব্রেনডেড অবস্থায় নিয়ে আসা হয় মেহসাকে। তাঁর মাথায় এবং পায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল। মেহসার কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ার দাগ ছিল বলেও দাবি করেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। মেহসাকে পুলিশ পিটিয়ে মেরে ফেলে বলে অভিযোগ তাঁর পরিবারের।


হিজাব বাধ্যতামূলক না রাখা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা


হাসপাতালে মেহসার স্ক্যান রিপোর্ট বলে কিছু ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয় কিছু হ্যাকার। তাতে মাথার খুলিতে আঘাতের চিহ্ন, ফোলা ভাব স্পষ্ট দেখা যায়। পুলিশ-প্রশাসন যদিও তা অস্বীকার করে। প্রশ্ন তোলে রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে। তবে তাতেও আন্দোলন থামেনি। জায়গায় জায়গায় একজোট হয়ে প্রতিবাদ চলছে দেশ জুড়ে। আগুনে হিজাব, স্কার্ফ খুলে জ্বালিয়ে দেওয়ার দৃশ্যও সামনে আসে।  বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দুই মাসে প্রায় ১৫ হাজার আন্দোলনকারী গ্রেফতার হয়েছেন ইরানে। সবমিলিয়ে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে সে দেশের আদালত।  জাতীয় নিরাপত্তা ভঙ্গ, শান্তি নষ্ট, সরকারি দফতরে অগ্নিসংযোগ এবং অপরাধমূলক কাজকর্মের ধারা প্রয়োগ করা হয় তাঁদের উপর। তবে নয়া ঘোষণায় শেষ মেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে এগোচ্ছে বলে আশাবাদী আন্দোলনকারীরা।