জয়ন্ত ঘোষাল, আনন্দবাজার পত্রিকা
উন্নয়ন আর শিল্পায়ন।
দ্বিতীয় ইনিংসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল মন্ত্র এখন এটাই। গত কাল রাতে মিউনিখ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে রোটাচ ইগার্ন নামের এক প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছে মমতা এই প্রতিবেদককে জানান, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে এখন বিনিয়োগ এবং শিল্পায়নের অনুকূল পরিস্থিতি গড়ে তোলার সময় এসেছে। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনুকূলে। দেশ-বিদেশের শিল্পপতিদের কাছে পশ্চিমবঙ্গকে বিনিয়োগের গন্তব্যস্থল করে তোলার দায়িত্ব আমাদের।’’ মমতা বলেন, ‘‘সকলের সহযোগিতা নিয়ে আমরা নিশ্চয়ই সফল হব।’’
আজ মিউনিখে শিল্প সম্মেলন। জার্মানির বহু শিল্প বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা আজ এখানে উপস্থিত থাকবেন। গতকাল বিএমডব্লিউয়ের সদর দফতরে সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট টমাস বেকার-সহ একটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল দীর্ঘ বৈঠক করেন। বিএমডব্লিউয়ের পক্ষ থেকে তিনটি প্রেজেন্টেশন পেশ করা হয়। বৈঠকে স্থির হয়, সংস্থার পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল কলকাতায় পাঠানো হবে। রাজ্য সরকার এবং বিএমডব্লিউ সংস্থা দু’তরফের একজন করে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হবে, যাঁরা নিজেরা বসে ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি স্থির করবেন।
পরে অমিত মিত্র সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘বিএমডব্লিউ এখন গাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে নতুন নতুন পরিবর্তন আনছে। তৈরি হচ্ছে হাইব্রিড গাড়ি, অর্থাৎ বৈদ্যুতিক ছোট ছোট গাড়ি যেগুলি পেট্রোল থেকে বৈদ্যুতিক মাধ্যমে আবার বৈদ্যুতিক মাধ্যম থেকে পেট্রোলে পরিবর্তন করা যায়। রাজ্য এই ধরনের প্রকল্পে আগ্রহী।’’ অর্থমন্ত্রী জানান, এই প্রকল্পের সুবিধা হল, এর জন্য বিপুল জমির প্রয়োজন নেই। ১৩০ একর জমিতেই গড়ে তোলা যায় হাইব্রিড গাড়ির কারখানা। অমিতের কথায়, ‘‘মোটর সাইকেল কিংবা ছোট ছোট গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য ওরা যদি কারখানা করে, রাজ্য সরকার তাতেও আগ্রহী।’’ আজকের বৈঠকে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের জানানো হয়েছে, গাড়ির ভিতরে ব্যবহৃত তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও বিএমডব্লিউ নতুন নতুন কাজ করছে, গুগল সংস্থার অংশীদারিও রয়েছে তাদের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রেও সহযোগিতায় আগ্রহী রাজ্য।
গতকালের বৈঠকে অমিত মিত্রের সঙ্গে ছিলেন বন্ধন ব্যাঙ্কের কর্ণধার চন্দ্রশেখর ঘোষ, সুমিত ডেবরিওয়াল, কাইনেটিক সংস্থার প্রধান সুলজ্জা মোতওয়ানি, সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যের মুখ্যসচিব, অর্থসচিব প্রমুখ। বিএমডব্লিউয়ের প্রতিনিধিদল অদূর ভবিষ্যতে কলকাতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলেই আপাতত ঠিক হয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মিউনিখে এসে এমন কোনও বার্তা দিতে চাইছেন না যে পশ্চিমবঙ্গে তিনি বিনিয়োগের স্রোত বইয়ে দেবেন। ঘরোয়া ভাবে তিনি জানিয়েছেন, সিপিএম জমানায় বিনিয়োগের যে ফানুস ওড়ানো হয়েছিল তার ঘোরতর বিরোধী তিনি। বামফ্রন্টের নিরুপম সেনও এসেছিলেন এই মিউনিখেই, তখন সফরসঙ্গী হিসেবে এই প্রতিবেদকও এসেছিলেন। নিরুপমবাবুও বিএমডব্লিউ কারখানা পরিদর্শন করেছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে মমতা বিষয়টি নিয়ে কোনও বড় রকমের প্রচারে না গিয়ে শুধু বলছেন, ‘‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি-র আমন্ত্রণে রোমে আসার কথা ছিলই। একটি দেশে এলে কাছাকাছি আরও একটি দেশে যাওয়ার জন্যও কূটনৈতিক অনুরোধ থাকে। এক্ষেত্রেও মিউনিখ ছাড়াও প্যারিস-সহ বেশ কিছু শহরের মধ্যে বেছে নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আমি মিউনিখকেই বেছে নিয়েছি।’’ মমতার যুক্তি, ‘‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, উৎপাদন শিল্পের এক বিরাট উন্নতি ঘটেছে এখানে। মাঝারি শিল্পেও বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ হয়েছে। যা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারী শিল্প পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে খুবই জরুরি, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ছোট ও মাঝারি শিল্পকে আমরা ডাকব না।’’
অনেক জার্মান ব্যবসায়ী ভারতে এবং ভারতীয় ব্যবসায়ী এখানে যৌথ বা একক ভাবে ভাল ব্যবসা করছেন। মমতার মতে, সেগুলিকে আরও উৎসাহিত করলে আখেরে লাভ হবে রাজ্যেরই। যেমন, সরোজ পোদ্দার জার্মানির আন্দ্রেজ হেটিজ-এর সঙ্গে আসবাবপত্র ফিটিংস-এর ব্যবসা করছেন দীর্ঘদিন ধরে, তাঁর ব্যবসার পরিমাণ সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। দুগ্ধজাত পণ্য ক্ষেত্রে কলকাতার ব্যবসায়ী জালানেরা জার্মানির সংস্থার সঙ্গে সফল ভাবে ব্যবসা করছেন। এঁদের উৎসাহিত করাটাও বড় কাজ বলে মনে করছেন মমতা। এই
বাণিজ্য আরও বাড়লে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে বলে মনে করছে রাজ্য সরকার।
অমিত মিত্র এ দিন জািনয়েছেন, আগামী বছর ২০ জানুয়ারি ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’ উদ্বোধন করবেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। উপস্থিত থাকবেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’-এ যোগ দেওয়ার জন্য নর্থ রাইন এবং ওয়েস্টফ্যালিয়া, এই দুই রাজ্যের প্রিন্সিপাল মিনিস্টারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর মতে, একটা বৈঠক অথবা সফরেই বিনিয়োগ চলে আসবে— ব্যাপারটা এমন নয়। কিন্তু বিনিয়োগের সুযোগ তৈরির জন্য সব রকম চেষ্টা করা হবে।