বেজিং: যুদ্ধের বিরোধিতা করলেও, শুরু থেকেই রাশিয়াকে নিয়ে সুর নরম ছিল চিনের (China on Russia-Ukraine Conflict)। এ বার ইউক্রেনকে নিয়ে রাশিয়ার কঠোর অবস্থাকেও যুক্তিসঙ্গত বলে উল্লেখ করল চিন। তারা জানিয়েছে, সব দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমিকতার প্রতি সম্মান রয়েছে তাদের। তাই ইউক্রেনকে নিয়ে নিরাপত্তাজনিত যে দুশ্চিন্তা রয়েছে রাশিয়ার, তা অনুধাবন করতে সক্ষম তারা।


বিগত দু’মাস ধরে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যে সংঘাত শুধুমাত্র চোখ রাঙানিতে আটকে ছিল, বৃহস্পতিবার সকাল তা আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধের আকার ধারণ করেছে। সীমান্ত টপকে ইউক্রেনে প্রবেশ করেছে রুশ সেনা। একাধিক শহরে ক্ষপণাস্ত্র হানা হয়েছে। তাতে সেনা এবং সাধারণ মানুষ মিলিয়ে ৪০ জন ইউক্রেনীয় নাগরিক মারা গিয়েছেন। তাতে রাশিয়ার সঙ্গে সমস্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে ইউক্রেন।


এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার ফোনে রুশ বিদেশমন্ত্রী সেরগেই লাভরভের সঙ্গে কথা বলেন চিনা স্টেট কাউন্সিলর তথা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই। সেখানেই রাশিয়ার নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগকে সমর্থন জানান তিনি। তবে একই সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধের পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে আলাপ-আলোচনা এবং মীমাংসার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আবেদন জানান ওয়াং।


তবে আমেরিকা এবং ন্যাটোর তরফে উস্কানি না থাকলে পরিস্থিতি এই পর্যায়ে পৌঁছত না বলে ওয়াংকে সাফ জানিয়ে দেন লাভরভ। তিনি জানান, মিনস্ক চুক্তির ধার ধারেনি আমেরিকা এবং ন্যআটো। বরং ক্রমশ পূর্ব দিকে সেনা সম্প্রসার করছিল তারা। ২০১৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে স্বাক্ষরিত চুক্তিও লঙ্ঘন করেছে তারা। তাই নিজেদের অধিকার, নিরাপত্তা এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থেই কড়া পদক্ষেপ করতে হয়েছে মস্কোকে।


আরও পড়ুন: Ukraine Russia War: রুশ আক্রমণ শুরু, কী করবে ইউক্রেন? কী পদক্ষেপ নিতে পারে আমেরিকা বা ন্যাটো?


১৯৯১ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইউক্রেন। তার পর তিন দশক কেটে গেলেও, ইউক্রেনকে এখনও ছিন্নমূল হিসেবেই দেখে রাশিয়া। এমনকি ইউক্রেনের পশ্চিম অংশের নাগরিকদের একটি বড় অংশ এখনও রাশিয়াকেই মাতৃদেশ হিসেবে গন্য করেন। ব্যবসা-বাণিজ্যেও পরস্পরের উপর নির্ভরশীল দুই দেশ। 


২০১০ থেকে ২০১৪ সালে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীনই দু’দেশের মধ্যে সংঘাত চরমে ওঠে। মস্কোর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফে চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু পত্রপাঠ তা খারিজ করে দেন ইয়ানুকোভিচ। তার পরই ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত ক্রাইমিয়াকে নিজেদের ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে তাকে রিপাবলিক অফ ক্রাইমিয়া এবং সেভাস্তোপোল, দুই যুক্তরাষ্ট্রীয় অঞ্চল হিসেবে নামাঙ্কিত করে।  


আন্তর্জাতিক মহল যদিও আজও ক্রাইমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ হিসেবেই ধরে। তবে সেই থেকে সংঘাত চরম থেকে চরমতর হতে শুরু করে। ইউক্রেনের শিল্পাঞ্চল দোনবাসে সেনা পাঠায় রাশিয়া। দু’পক্ষের সংঘর্ষে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। ইউক্রেনের পূর্ব অংশের বিচ্ছিন্নতাকামীদেরও রাশিয়া সরাসরি সমর্থন এবং অস্ত্রশস্ত্রের জোগান দিতে শুরু করে বলে অভিযোগ।


সেই সময় আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো দেশের সমর্থন পেতে শুরু করে ইউক্রেন। সেই সময় রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের হাত মজবুত করতে দ্য নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো)-র আওতায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা শুরু করে পশ্চিমি দেশগুলি। কিন্তু তাতে তীব্র আপত্তি জানায় রাশিয়া। তাদের অভিযোগ ছিল, সেনার যৌথ মহড়ার পাশাপাশি ইউক্রেনকে অস্ত্রশিক্ষা দিচ্ছে আমেরিকা এবং ন্যাটো (NATO)।


কূটনীতিকদের মতে, যে ১৪টি দেশের সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্ত রয়েছে, তার মধ্যে পাঁচটি দেশে ন্যাটোর সদস্য (Russia Ukraine War News)। ইউক্রেনও (Ukraine Russia Crisis) ন্যাটোর সদস্যপদ পেলে আমেরিকা তাদের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলবে, সেনা শিবির গড়বে। তাতেই ইউক্রেনের সদস্যপদ পাওয়ায় রাশিয়ার আপত্তি বলে মনে করেন কূটনীতিবিদরা। তার মধ্যেই ২০২০ সালে ন্যাটোর এনহ্যান্সড অপারচুনিটি পার্টনার প্রকল্পে যোগ দেয় ইউক্রেন, যার আওতায় যে কোও দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দিলে পরস্পরকে অস্ত্র এবং সামরিক সাহায্য দেওয়া যাবে। ২০২১-এর ২৮ জুন কৃষ্ণ সাগরে যৌগ মহড়া দেয় ন্যাটো এবং ইউক্রেন বাহিনী।


এর পরই ২০২১-এর নভেম্বরে কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে দেখা যায়, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে ইউক্রেন সীমান্তে অবস্থান করছে ১ লক্ষের বেশি রুশ সেনা। সেনা না সরালে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানো হবে বলে সেই সময় রাশিয়াকে হুঁশিয়ারি দেন বাইডেন। কিন্তু রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (Vladimir Purin) নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখান। ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া হলে এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ থেকে সেনা না সরালে, তাঁরাও সেনা সরাবেন না বলে জানিয়ে দেন পুতিন। সেই থেকেই সংঘাত বাড়তে বাড়তে  যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।