সুজয় চক্রবর্তী


এই প্রথম আমাদের সৌরমণ্ডলে এমন কোনও ‘চাঁদ’ পাওয়া গেল যা সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে। একের পর এক সমুদ্র বা মহাসাগর। সেগুলি যেমন আকারে বিশাল, তেমন তাঁদের গভীরতাও অনেক অনেক গুণ বেশি। যেগুলি ভেসে যাচ্ছে তরল মিথেনে।

পৃথিবী ছাড়া এই সৌরমণ্ডলে আরও দু’টি গ্রহ- বৃহস্পতি, শনি আর তাদের ‘চাঁদ’গুলিতে বড় বড় সমুদ্র আছে বলে অনেক দিন ধরেই ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। যৌথ ভাবে, নাসা এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি’র (এসা) পাঠানো মহাকাশযান ‘ক্যাসিনি’ একেবারে হাতেনাতে প্রমাণ পেয়ে গেল- এই সৌরমণ্ডলে শনির ‘চাঁদ’-টাইটানও ভেসে যাচ্ছে সমুদ্রে।

‘ক্যাসিনি’ মহাকাশযানের পাঠানো তথ্য জানিয়েছে, টাইটানের পৃষ্ঠদেশে ৬ লক্ষ ২০ হাজার বর্গ মাইল বা ১৬ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন সাগর, মহাসাগর। যা টাইটানের পৃষ্ঠদেশের দুই শতাংশ। এই সমুদ্রগুলি রয়েছে টাইটানের উত্তর মেরুতে। তাদের নাম ‘লাইগেইয়া মেয়ার’, ‘ক্র্যাকেন মেয়ার’ ও ‘পাঙ্গা মেয়ার’। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মহাসাগরটির নাম- ‘ক্র্যাকেন মেয়ার’। ‘লাইগেইয়া’ দ্বিতীয় বৃহত্তম। তা ছাড়াও শনির চাঁদ টাইটানের দক্ষিণ মেরুতে গত বছর প্রচুর নদী ও হ্রদের হদিশ মিলেছিল।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এই সাগর-মহাসাগরগুলি কী দিয়ে ভরা?

তা কী জল? ক্যাসিনি জানাচ্ছে, না। সেখানে রয়েছে শুধুই তরল মিথেন আর ইথেনের মতো হাইড্রোকার্বন। জলের বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব নেই সেখানে।

সেই সমুদ্রগুলির গভীরতা কতটা?

‘লাইগেইয়া’ মহাসাগরের গভীরতা ৫২৫ ফুট বা ১৬০ মিটার। তা ছাড়াও বৃহস্পতির দু’টি চাঁদ ‘গ্যানিমিদ’ আর ‘ইউরোপা’-তেও বড় বড় সাগর, মহাসাগর রয়েছে বলে মনে করেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তা হাতে-কলমে প্রমাণ করা যায়নি। এ বার প্রশ্ন উঠতেই পারেস সেই তরল মিথেন বা তরল ইথেন কী ভাবে জন্মাল শনির চাঁদ টাইটানে?

‘ক্যাসিনি’র রাডার ইনস্ট্রুমেন্টের তদারকির দায়িত্বে থাকা ফ্রেঞ্চ রিসার্চ ল্যাবরেটরি ‘ল্যাটমস’-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যালিস লঁ কল বলেছেন, ‘‘আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, ওই সাগর, মহাসাগরগুলি ভরা রয়েছে তরল ইথেনে। কিন্তু ‘ক্যাসিনি’র পাঠানো তথ্য আমাদের সেই ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছে। আমাদের অবাক করে দিয়ে ‘ক্যাসিনি’ জানিয়েছে, সূর্যের থেকে অত দূরে থাকলেও, শনির চাঁদ টাইটানের ‘বায়ুমণ্ডল’ (অ্যাটমসফিয়ার) একেবারে আমাদের পৃথিবীর মতোই ঘন। সেই ‘বায়ুমণ্ডলে’ রয়েছে প্রচুর নাইট্রোজেন। যা প্রায় ৯৫ শতাংশ। তবে শনির চাঁদের ‘বায়ুমণ্ডলে’ অক্সিজেনের পরিমাণ কম। নাইট্রোজেন ছাড়াও সেই ‘বায়ুমণ্ডলে’ রয়েছে মিথেন, ইথেন আর অন্যান্য কিছু গ্যাস। নাইট্রোজেন ও মিথেনের মধ্যে বিক্রিয়া হলে কিছু মিথেন তরল হয়ে  বৃষ্টির আকারে ঝড়ে পড়ে। আর সেই ভাবেই তা শনির ‘চাঁদে’র মহাসাগরগুলি ভরিয়ে তোলে। অন্য নদী বা হ্রদগুলি থেকে তরল মিথেন এসে ওই মহাসাগরগুলিতে মেশে।

‘ক্যাসিনি’ শনির কক্ষপথে ঢুকেছিল ২০০৪ সালে। আর এই তথ্যগুলি পাওয়া গিয়েছে ২০১৫ সালের শেষে। সম্প্রতি এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে বিশিষ্ট বিজ্ঞান-জার্নাল, ‘জার্নাল অব জিওফিজিক্যাল রিসার্চ: প্ল্যানেট্‌স’-এ।

এই মিথেনে ভরা মহাসাগরের অস্তিত্ব কী শনির চাঁদে প্রাণের সম্ভাবনাকে সত্যি-সত্যিই জোরদার করে তুলল?

নাসার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ‘‘টাইটানের ‘বায়ুমণ্ডলে’ প্রচুর জৈব অণুর হদিশ মিলেছে। তার ফলে, আগামী দিনে অণুজীবের মতো ‘প্রাণে’র হদিশ মিলতেই পারে শনির ‘চাঁদ’- টাইটানেও।