কলম্বো: সরকার বিরোধী আন্দোলনে ফুঁসছে গোটা দেশ (Sri Lanka Crisis)। তার মধ্যেই টালমাটাল অবস্থা মসনদের। তাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে মহিন্দা রাজাপক্ষ (Gotabaya Rajapaksa) ইস্তফা দিয়েছেন বলে শোনা গিয়েছিল প্রথমে। তাঁর দফতর যদিও সেই খবরকে রটনা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ বার জানা গেল, মহিন্দার ছেলে নামাল রাজাপক্ষ (Namal Rajapaksa) মন্ত্রিপদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। মহিন্দা সরকারের যুব এবং ক্রীড়মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।


তুমুল অশান্তির মধ্যে অব্যাহতি নিলেন মহিন্দা-পুত্র


দেশ জুড়ে অশান্ত পরিবেশের মধ্যেই রবিবার রাতে টুইটারে নিজের পদত্যাগের কথা জানান নামাল। লেখেন, ‘প্রেসিডেন্টের সচিবকে সমস্ত পদ থেকে ইস্তফার কথা জানিয়ে দিয়েছি। এই মুহূর্ত থেকে পদত্যাগ করছি। আশাকরি, আমার পদক্ষেপে দেশের নাগরিক এবং সরকারের মধ্যে স্থিতাবস্থা ফিরে আসবে। নিজের ভোটার, দল এবং হামবনথোটার নাগরিকদের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আমি।’


বিক্ষোভ সামাল দিতে শনিবারই টুইটার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব-সহ সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্লক করে দেয় শ্রীলঙ্কা সরকার। জরুরি অবস্থা ঘোষণার পাশাপাশি, ৩৬ ঘণ্টার কার্ফু জারি করা হয়। কিন্তু তার পরও বিক্ষোভ থামেনি। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে মহিন্দা এবং প্রেসিডেন্ট পদ থেকে গোতাবায়ার ইস্তফা চেয়ে রবিবারও রাস্তায় ঢল নামে মানুষের। অর্থনৈতিক সঙ্কটে সরকারে ভূমিকার বিরুদ্ধে পেরাডেনিয়ায় সরব হন কলেজ পড়ুয়ারা। জলকামান দেগে, কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে পুলিশ।


কিন্তু এতকিছুর পরেও বিক্ষোভ হটেনি। বরং বিরোধী রাজনীতিকদের সঙ্গে মিলে ১০০ জন বিক্ষোভকারী রাজধানী কলম্বোর উদ্দেশে রওনা দেন। বিরোধী দলনেতা সজিত প্রেমদাসের বাসভবনের সামনে তাঁদের রুখে দেয় পুলিশ। নামানো হয় সশস্ত্র বাহিনীও। তার মধ্যেই জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন মহিন্দা। তা নিয়ে বিরোধীরা যখন পরবর্তী কৌশলে ব্যস্ত, সেই সময় মহিন্দার দফতর থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, ইস্তফার খবরে সত্যতা নেই। ইস্তফা দেননি মহিন্দা।



এর কিছু ক্ষণ পরই টুইটারে নিজের ইস্তফার কথা জানান নামাল। এর আগে শনিবার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্লক করা নিয়ে সরকারের সমালোচনা করেছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন। সরকারি নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর উপায় এখন মানুষের হাতে পৌঁছে গিয়েছে। ভিপিএন ব্যবহার করে দিব্যি নিষিদ্ধ সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে বিচরণ করতে পারেন তাঁরা। তিনি নিজেও ভিপিএন ব্যবহার করেই টুইট করছেন। তাই এই নিষেধাজ্ঞা অর্থহীন। সেই নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যেই ইস্তফা দিলেন তিনি।


আরও পড়ুন: Sri Lanka PM Resigns: চাপের মুখে ইস্তফা শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর! দাবি খারিজ করল রাজাপক্ষর দফতর


স্বাধীনতার পর এমন সঙ্কট কখনও দেখা দেয়নি শ্রীলঙ্কায়


এ দিকে, সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত আপাতত কার্ফু থাকছে শ্রীলঙ্কায়। এই সময়সীমার মধ্যে সরকার বিরোধী আন্দোলন, জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইন লঙ্ঘন করায় এখনও পর্ন্ত ৬৬৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেখানে। দেশের আইন অনুযায়ী, বিচার প্রক্রিয়া ছাড়াই অশান্তি তৈরির দায়ে সে দেশের সেনা যে কোনও ব্যক্তিকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্দি করে রাখতে পারে। সেই নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েও মহিন্দার যুক্তি, জরুরি পরিষেবা অব্যাহত রাখতে এবং আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা ছাড়া উপায় ছিল না তাঁর সরকারের।


তাঁর সরকারের এই দমননীতির বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। #GoHomeRajaPaksas, #GoataGoHome হ্যাশট্যাগে ছেয়ে গিয়েছে চারিদিক। তারই মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হচ্ছেন দেশের সাধারণ নাগরিক। খাদ্যসঙ্কট দেখা দিয়েছে দেশ জুড়ে। তার জেরে নিত্য প্রয়োজনের চালের দাম কেজিতে ২২০ টাকা, ১৯০ টাকা কেজি দরে গম, ২৪০ টাকা কেজি দরে চিনি, ৮৫০ টাকা প্রতি লিটারে নারকেল তেলের দাম পৌঁছেছে। একটি ডিমের দাম পড়ছে ৩০ টাকা। গুঁড়ো দুধের দাম ১৯০০ টাকা কেজিতে পৌঁছেছে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে শ্রীলঙ্কা কখনও এমন সঙ্কটের মধ্যে পড়েনি।


এই পরিস্থিতির জন্য রাজাপক্ষ পরিবারকেই দুষছেন দেশের আম নাগরিক। তাঁদের হাতে দেশের অর্থনীতির দফারফা হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ করছেন তাঁরা। এ ব্যাপারে এক মত বিশেষজ্ঞরাও। তাঁদের মতে, সরকারের গাফলতিতেই বাজেটে ঘাটতি তো বটেই, অর্থনৈতিক সঙ্কট ঘাড়ে চেপে বসেছে গোটা দেশের। তাতে গোদের উপর বিষফোড়া হয়ে ওঠে রাজাপক্ষ সরকারের করনীতি। কারণ ২০১৯ সালে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে বিপুল করছাড়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রাজাপক্ষ। ক্ষমতায় এসে সেই প্রতিশ্রুতিপূরণে উদ্যোগী হন তিনি। কিন্তু তার পরই কোভিডের প্রকোপ নেমে আসে। ফলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়।


পর্যটন থেকে বিপুল লাভ ঘরে তোলে শ্রীলঙ্কা সরকার। কিন্তু অতিমারিতে তার উপরও প্রভাব পড়ে। সেখানে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের বেতনেও কোপ পড়ে। ফলে বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় শ্রীলঙ্কার। পর্যটন ব্যবসার উপরও তার প্রভাব পড়ে। একই সঙ্গে চিনের থেকে নেওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝাও দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। কারণ গচ্ছিত বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ই গত দু'বছরে ৭০ শতাংশ নেমে যায়। এ ছাড়াও, ২০২১ সালে কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন রাজাপক্ষ। পরে যদিও নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়, কিন্তু তত দিনে কৃষিকার্যে বিপুল ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। 


এ বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার কোষাগারে ২৩১ কোটি ডলার ঋণের বোঝা ছিল। কিন্তু তাদের ঋণের বোঝাই ৪০০ কোটি ডলার। ইন্টারন্যাশনাল সভরেঁ বন্ডে ১০০ কোটি ডলারের ঋণের পাশাপাশি, এশিয়ান জেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, জাপান এবং চিনের থেকেও ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। তা নিয়ে গত মাসেই বিপদের বার্তা শুনিয়েছিল আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার। ঋণের বোঝা বাড়তে বাড়তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে জানানো হয়।