কলম্বো: দেশ জুড়ে চরম অস্থিরতা। অর্থনৈতিক সঙ্কট (Sri Lanka Economic Crisis) ডেকে এনেছে খাদ্যসঙ্কটের বিভীষিকাও। তাতে নাকি চাপে পড়ে ইস্তফা দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজাপক্ষ (Mahinda Rajapaksa)। রবিবার সন্ধ্যায় শ্রীলঙ্কার সংবাদমাধ্যেমেই প্রকাশিত হয় এই খবর। বলা হয়, নিজের ভাই তথা  শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষর (Gotabaya RajaPaksa)কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন তিনি। দেশের সরকার এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনতেই এমন পদক্ষেপ করেছেন বলে জানিয়েছেন মহিন্দা। কিন্তু সূত্রের দাবি, সন্ধ্যা গড়াতেই মহিন্দার দফতর থেকে এই খবরে সত্যতা নেই বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, পদত্যাগ করেননি রাজাপক্ষ। তবে এখনও পর্যন্ত কিছু স্পষ্ট নয়।  দেশবাসীর দাবি মেনে মহিন্দা এবং গোতাবায়া আদৌ ইস্তফা দেবেন কি না, তা নিয়েও কিছু খোলসা করেনি তারা।



চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট জেঁকে বসেছে শ্রীলঙ্কায়


উল্লেখ্য, ঋণভারে জর্জরিত শ্রীলঙ্কায় আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল ঢের আগেই। কিন্তু এ বছরের শুরু থেকে পরিস্থিতি চরমে ওঠে। ফেব্রুয়ারি মাসে সেখানে খুচরো ব্যবসায় মুদ্রাস্ফীতি ১৭. ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়ে হয় ২৫ শতাংশ। তার জেরে চাল, ডাল, গম এবং সবরকমের শস্যদানা, যা কিনা জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যক, সব কিছুই সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যা। এমন পরিস্থিতিতে শ্রীলঙঅকা জুড়ে চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তার জেরে শুরু হয়েছে খাদ্য সঙ্কটও। 


এই মুহুর্তে সে দেশের রাজধানী কলম্বোয়  চালের ন্যূনতম দাম ২০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। ১ কেজি চাল কিনতে সেখানে ২২০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। গম বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ১৯০ টাকা কেজি দরে। কেজিতে ২৪০ টাকা দাম রাখা হয়েছে চিনির। নারকেল তেলের দাম পৌঁছেছে প্রতি লিটারে ৮৫০ টাকায়। একটি ডিম কিনতে সেখানে ৩০ টাকা দিতে হচ্ছে গ্রাহককে।


শুধু তাই নয়, প্রাপ্তবয়স্করা অল্প খেয়ে শিশুদের মুখে খাবারের জোগান দেবেন যে, সেই অবস্থাও নেই। কারণ সেখানে প্রতি কেজি গুঁড়ো দুধের দাম পৌঁছেছে ১৯০০ টাকায়। সবজি সেদ্ধ করে খাওয়ার উপায়ও নেই। কারণ বিগত কয়েক সপ্তাহের সবজির দাম বাড়তে বাড়তে দ্বিগুণ, ত্রিগুণ থেকে প্রায় চতুর্গুণ হয়ে গিয়েছে।  তার উপর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে ওষুধের জোগানে ঘাটতি ঘিরেও।  



তাতে মহিন্দা এবং গোতাবায়ার উপরই ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের। তাঁদের অভিযোগ, সরকাররে অক্ষমতার জন্যই দেশের অর্থনীতির দফারফা হয়ে গিয়েছে। এই যুক্তি যদিও অমূলক নয় বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের দাবি, বাজেটের ঘাটতি তো পোষাতেই পারেননি, তাতে গোদের উপর বিষফোড়া হয়ে ওঠে রাজাপক্ষ সরকারের কর নীতি। কারণ ২০১৯ সালে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে বিপুল করছাড়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রাজাপক্ষ। ক্ষমতায় এসে সেই প্রতিশ্রুতিপূরণে উদ্য়োগী হন তিনি। কিন্তু তার পরই কোভিডের প্রকোপ নেমে আসে। ফলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়।


আরও পড়ুন: Sri Lanka Crisis: চাল ২২০ টাকা কেজি, গুঁড়ো দুধ ২ হাজার টাকার কাছাকাছি, খাদ্যসঙ্কট ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে শ্রীলঙ্কায়


পর্যটন থেকে বিপুল লাভ ঘরে তোলে শ্রীলঙ্কা সরকার। কিন্তু অতিমারিতে তার উপরও প্রভাব পড়ে। সেখানে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের বেতনেও কোপ পড়ে। ফলে বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় শ্রীলঙ্কার। পর্যটন ব্যবসার উপরও তার প্রভাব পড়ে। একই সঙ্গে চিনের থেকে নেওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝাও দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। কারণ গচ্ছিত বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ই গত দু'বছরে ৭০ শতাংশ নেমে যায়। এ ছাড়াও, ২০২১ সালে কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন রাজাপক্ষ। পরে যদিও নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়, কিন্তু তত দিনে কৃষিকার্যে বিপুল ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। 


রাজনৈতিক সঙ্কট, সাংবিধানিক অচলাবস্থা, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি শ্রীলঙ্কায়


২০১০ সালে নিজে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দাদা মহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসানোর ঘোষণা করেন গোতাবায়া। দেশের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও জনগণের রায়কে সম্মান জানিয়ে সরে যান রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে। ফলে তামিল টাইগার বিদ্রোহ দমন থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্ত মহিন্দার ক্ষমতায় বসা আটকায়নি। এর আগে, ২০১৮-র ২৬ অক্টোবর তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসিয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপাল সিরিসেনা। মাহিন্দার পরে প্রেসিডেন্ট হন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সিরিসেনা। তিনি মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী করেও টিকিয়ে রাখতে পারেননি। সেবারও তাঁর আমলেই শঅরীলঙ্কার রাজনীতিতে দীর্ঘ অচলাবস্থা এবং অভূতপূর্ব সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হয়। সেই সময় মহিন্দার ক্ষমতায় থাকাকে বেআইনি ঘোষণা করে দেশের শীর্ষ আদালত।