নয়াদিল্লি: আফগানিস্তানে (Afghanistan War) দু’দশক ব্যাপী যুদ্ধের ক্ষত এখনও দগদগে। তার মধ্যেই ফের সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল আমেরিকা (United States of America/US)। তবে এ বার আর ঠান্ডা যুদ্ধ নয়, সরাসরি রাশিয়ার (Russia) বিরুদ্ধে অস্ত্রসরঞ্জাম সাজাতে শুরু করেছে তারা। কোনও রাখঢাক না করেই তাই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (Joe Biden) জানিয়েছেন, ইউক্রেনকে (Ukraine) আক্রমণ করতে এগোচ্ছে রাশিয়া। তাই যুদ্ধ আসন্ন।
১৯৯১ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইউক্রেন (Russia-Ukraine Conflict)। তার পর তিন দশক কেটে গেলেও, ইউক্রেনকে এখনও ছিন্নমূল হিসেবেই দেখে রাশিয়া। এমনকি ইউক্রেনের পশ্চিম অংশের নাগরিকদের একটি বড় অংশ এখনও রাশিয়াকেই মাতৃদেশ হিসেবে গন্য করেন।
এমন পরিস্থিতিতে কার্যতই দিশেহারা অবস্থা ইউক্রেনের। ভৌগলিক অবস্থানের জেরে রাশিয়াকে টপকে আমেরিকা, ব্রিটেনের বলে বলীয়ান হওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে, কারণ সে ক্ষেত্রে সবরকম ভাবে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল ইউক্রেনে কার্যতই খাদ্য, বস্ত্র, পণ্যের জোগানে ভাটা পড়বে। আবার চোখ-কান বুজে রাশিয়ার আধিপত্য মেনে নেওয়াও অসম্ভব। এর মধ্যে চিন আবার সরাসরি রাশিয়ার সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। তাতেই পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোরাল হয়ে উঠছে।
কিন্তু ছিন্নমূল হয়েও বিশ্বের একাধিক দেশ যেখানে পাশাপাশি অবস্থান করছে, সেখানে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে তিক্ততা লাগাতার কেন বেড়ে চলেছে, আন্তর্জাতিক মহলেরই বা কী ভূমিকা, জেনে নিন বিশদে—
২০১০ থেকে ২০১৪ সালে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীনই দু’দেশের মধ্যে সংঘাত চরমে ওঠে। মস্কোর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফে চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু পত্রপাঠ তা খারিজ করে দেন ইয়ানুকোভিচ। তার পরই ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত ক্রাইমিয়াকে নিজেদের ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে তাকে রিপাবলিক অফ ক্রাইমিয়া এবং সেভাস্তোপোল, দুই যুক্তরাষ্ট্রীয় অঞ্চল হিসেবে নামাঙ্কিত করে।
আন্তর্জাতিক মহল যদিও আজও ক্রাইমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ হিসেবেই ধরে। তবে সেই থেকে সংঘাত চরম থেকে চরমতর হতে শুরু করে। ইউক্রেনের শিল্পাঞ্চল দোনবাসে সেনা পাঠায় রাশিয়া। দু’পক্ষের সংঘর্ষে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। ইউক্রেনের পূর্ব অংশের বিচ্ছিন্নতাকামীদেরও রাশিয়া সরাসরি সমর্থন এবং অস্ত্রশস্ত্রের জোগান দিতে শুরু করে বলে অভিযোগ।
সেই সময় আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো দেশের সমর্থন পেতে শুরু করে ইউক্রেন। সেই সময় রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের হাত মজবুত করতে দ্য নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো)-র আওতায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা শুরু করে পশ্চিমি দেশগুলি। কিন্তু তাতে তীব্র আপত্তি জানায় রাশিয়া। তাদের অভিযোগ ছিল, সেনার যৌথ মহড়ার পাশাপাশি ইউক্রেনকে অস্ত্রশিক্ষা দিচ্ছে আমেরিকা এবং ন্যাটো (NATO)।
কূটনীতিকদের মতে, যে ১৪টি দেশের সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্ত রয়েছে, তার মধ্যে পাঁচটি দেশে ন্যাটোর সদস্য। ইউক্রেনও (Ukraine Russia Crisis) ন্যাটোর সদস্যপদ পেলে আমেরিকা তাদের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলবে, সেনা শিবির গড়বে। তাতেই ইউক্রেনের সদস্যপদ পাওয়ায় রাশিয়ার আপত্তি বলে মনে করেন কূটনীতিবিদরা। তার মধ্যেই ২০২০ সালে ন্যাটোর এনহ্যান্সড অপারচুনিটি পার্টনার প্রকল্পে যোগ দেয় ইউক্রেন, যার আওতায় যে কোও দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দিলে পরস্পরকে অস্ত্র এবং সামরিক সাহায্য দেওয়া যাবে। ২০২১-এর ২৮ জুন কৃষ্ণ সাগরে যৌগ মহড়া দেয় ন্যাটো এবং ইউক্রেন বাহিনী।
আরও পড়ুন: Afghanistan Crisis Live Updates : কাবুলে ভারতীয় দূতাবাস প্রহরায় আইটিবিপি-র সশস্ত্র রক্ষীরা
এর পরই ২০২১-এর নভেম্বরে কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে দেখা যায়, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে ইউক্রেন সীমান্তে অবস্থান করছে ১ লক্ষের বেশি রুশ সেনা। সেনা না সরালে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানো হবে বলে সেই সময় রাশিয়াকে হুঁশিয়ারি দেন বাইডেন। কিন্তু রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (Vladimir Purin) নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখান। ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া হলে এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ থেকে সেনা না সরালে, তাঁরাও সেনা সরাবেন না বলে জানিয়ে দেন পুতিন।
২০২২ সালের ৩ জানুয়ারি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদোমির জেলেনস্কি-র সঙ্গে কথা হয় বাইডেনের। রাশিয়া আক্রমণ করলে পেন্টাগনের তরফে ইউক্রেনকে সবরকমের সাহায্য দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি। ১০ জানুয়ারি জেনেভায় আমেরিকা এবং রাশিয়ার আধিকারিকরা বৈঠক করেন। কিন্তু সেখানে কোনও সমাধান সূত্র বেরোয়নি। ১৯ জানুয়ারি সরাসরি পুতিনকে হুঁশিয়ারি দেন বাইডেন। ইউক্রেনকে আক্রমণ করলে ফল ভাল হবে না বলে হুঁশিয়ারি দেন। এর পর মধ্য ইউরোপে সেনা এবং যুদ্ধবিমানের সংখ্যা বাড়াতে শুরু করে ন্যাটো। আমেরিকাও সেনা বাড়িতে শুরু করে।
এ বছর ২৬ জানুয়ারি রাশিয়ার দাবিদাওয়া প্রসঙ্গে আমেরিকা জানায়, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদ পেলেও মস্কোর উদ্বেগের বিষয়টি মাথায় রাখা হবে। কিন্তু দু’দিন পর পুতিন জানান, তাঁদের দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তবে সবরকম আলোচনার জন্য প্রস্তুত তিনি। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে দেখে আমেরিকাকে পিছু হটার বার্তা দেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দিলে তাঁর দেশ অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়বে বলে জানান। ৩১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে যোগ দেয় আমেরিকা এবং রাশিয়া। সেখানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সম্প্রসারবাদের অভিযোগ তোলে আমেরিকা। পাল্টা নিজেদের নিরাপত্তার সঙ্গে কোনও ভাবে আপস করবে না বলে জানিয়ে দেয় মস্কো।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল মাকরেঁর সঙ্গে বৈঠক করেন পুতিন। রুশ এবং ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রীর মধ্যেও। সেখানে ইউক্রেন নিয়ে পিছু হটবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন পুতিন। এর পর ১২ ফেব্রুয়ারি ভিডিয়ো কনফারেন্সে বাইডেন এবং পুতিনের মধ্যে কথা হয়। জি-৭ দেশও ইউক্রেন নিয়ে যৌথ বিবৃতি জারি করে। ১৫ জানুয়ারি রাশিয়া জানায়, ইউক্রেন সীমান্ত থেকে সেনা সরাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু সেনা সরানো হয়নি বলে পাল্টা দাবি করে ইউক্রেন।
এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার আমেরিকার কূটনীতিককে দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে রাশিয়া (US-Russia Conflict)। আমেরিকার দাবি, রাশিয়ার কূটনীতিকদের অন্তত তিন বছর সময় দেয় তারা। রাশিয়া তা করেনি। তাই যোগ্য জবাব দেবে তারা। সেই পরিস্থিতিতেই ইউক্রেন সরকার এবং দেশের পূর্ব অংশের বিচ্ছিন্নতাকামীদের মধ্যে দোষারোপ পাল্টা দোষারোপের পালা শুরু হয়েছে। ডনেৎস্ক এবং লুহানস্কে গোলাবর্ষণ হয়েছে বলে অভিযোগ সামনে আসছে। তাতে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বিচ্ছিন্নতাকামীদের দাবি, ইউক্রেন সরকার গোলাবর্ষণ করেছে। যদিও ইউক্রেন সরকারের অভিযোগ, রাশিয়ার মদতে বিচ্ছিন্নতাকামীরাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। সীমান্তে অশান্তি বাঁধিয়ে রাশিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের। শুক্রবার সকালে ইউক্রেন সরকার নতুন করে গোলাবর্ষণ করেছে বলেও দাবি বিচ্ছিন্নতাকামীদের।
যদিও রাশিয়ার দাবি, সংঘাতস্থল থেকে সেনা সরিয়ে নিয়েছে তারা। কিন্তু ন্যাটোর দাবি, দুনিয়াকে ভুল বোঝাচ্ছে রাশিয়া। যত সংখ্যক সেনা সরিয়ে নিয়েছে তারা, তার চেয়ে ঢের বেশি সেনা ফের মোতায়েন করা হয়েছে ইউক্রেন সীমান্তে। তাতেই বিভিন্ন জায়গা থেকে গোলাবর্ষণের খবর সামনে আসছে। কৃত্রিম উপগ্রহ সংস্থা ম্যাক্সার জানিয়েছে, তিন দিক থেকে প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার সেনা মোতায়েন করে ইউক্রেনকে ঘিরে রেখেছে রাশিয়া। তার ছবি ধরা পড়েছে কৃত্রিম উপগ্রহে। তবে আক্রমণের প্রস্তুতি চলছে কি না, তা নিশ্চিত ভাবে জানাতে পারেনি তারা। অন্য দিকে, চিন আবার রাশিয়ার সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। ফলে প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতোই ফের দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছে বিশ্বের তাবড় শক্তিধর রাষ্ট্র। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধের আশঙ্কা ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে বলেই মনে করছেন কূটনীতিবিদরা।