বার্লিন: পৃথিবীর বেশিরভাগ আবিষ্কারই হঠাৎ হয়ে গিয়েছে। কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই অন্য কিছু করতে গিয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা। ঠিক সেভাবেই এক শতাব্দীরও বেশি আগে এক্স-রে আবিষ্কার করে ফেলেন বিজ্ঞানী উইলহেলম রন্টজেন।


প্রচারবিমুখ এই বিজ্ঞানী নিজের গবেষণাগারে বসে একান্তে গবেষণা চালাতেন। তিনি বিজ্ঞানীদের আলোচনাসভাতেও খুব একটা যেতেন না। নিজের গবেষণার বিষয়ে কোনওরকম প্রচারও করতেন না রন্টজেন। এভাবেই গবেষণা করতে করতেই তিনি এক্স-রে আবিষ্কার করে ফেলেন।


দিনটি ছিল ১৮৯৫ সালের ৮ নভেম্বর। সন্ধেবেলা নিজের গবেষণাগারে বসে ক্যাথড-রে টিউবের মধ্যে দিয়ে আলো পাঠানোর বিষয়ে গবেষণা করছিলেন রন্টজেন। হঠাৎ তিনি দেখতে পান, ক্যাথড-রে টিউব থেকে অনেকটা দূরে থাকা একটি পর্দায় উজ্জ্বল ফ্লুরোসেন্ট রঙের আলো পড়ছে। কোথা থেকে এই উজ্জ্বল আলো আসছে, সেটা আবিষ্কারের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে দেন বিজ্ঞানী। তিনি কয়েক সপ্তাহ নাওয়া-খাওয়া ভুলে গবেষণাগারেই কাটিয়ে দেন। তারপর তিনি হঠাৎ আবিষ্কার করেন, কাচের ভ্যাকুয়াম টিউবে ক্যাথড রে পড়ে নতুন ধরনের অদৃশ্য রশ্মি তৈরি করছে। এই রশ্মির আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে। অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে এই রশ্মি এবং যে কোনও পর্দাকে উজ্জ্বল করে তোলে। কার্ডবোর্ড, কাঠ, তামা বা অ্যালুমিনিয়ামও এই রশ্মিকে বাধা দিতে পারে না। ফটোগ্রাফিক প্লেটে এই রশ্মির ফলে সৃষ্টি হওয়া ছবি ধরে রাখা যাচ্ছে।


এই আবিষ্কারের কথা অন্যদের না জানালে চলে না। তাই নিজের স্বভাববিরুদ্ধভাবে ১০ পাতার একটি প্রতিবেদন লিখে বিজ্ঞানীদের সংগঠনে পাঠিয়ে দেন রন্টজেন। তিনি নতুন রশ্মির নাম দেন ‘এক্স-রেডিয়েশন’ বা ‘এক্স-রে’। অন্যান্য বিজ্ঞানীরা এই রশ্মির নাম ‘রন্টজেন রে’ দেওয়ার কথা বললেও, রন্টজেন নিজে অবশ্য বরাবর ‘এক্স-রে’ নামটাই ব্যবহার করেন। শেষপর্যন্ত সেই নামই থেকে গিয়েছে।


শুরুতে অবশ্য অন্যান্য বিজ্ঞানীরা রন্টজেনের এই আবিষ্কারকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। কারণ, তাঁর পাঠানো প্রতিবেদনের সঙ্গে কোনও ছবি ছিল না। তবে ১৮৯৬ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপের পদার্থবিদদের উদ্দেশে এক্স-রে-র ছবি পাঠান রন্টজেন। সেই ছবিতে মাংসপেশি ভেদ করে হাড় দেখা যায়। বিজ্ঞানীদের কাছে এই ছবি পৌঁছনোর পরেই ইউরোপে আলোড়ন পড়ে যায়। সংবাদমাধ্যমে হইচই শুরু হয়ে যায়। একের পর এক ব্যক্তির চিকিৎসায় এক্স-রে ব্যবহার করা শুরু হয়ে যায়। এর সুফলের কথা সংবাদমাধ্যমে প্রশংসিত হয়। এক্স-রে-র মাধ্যমে এক ব্যালে নর্তকীর পায়ে ফুটে থাকা সূচের খোঁজ পাওয়া যায়। কানাডার মন্ট্রিলে এক তরুণের পায়ে গুলি লাগে। কয়েক সপ্তাহ ধরে চিকিৎসকরা বুঝতে পারছিলেন না, পায়ের ঠিক কোথায় গুলি লেগেছে। তারপর ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক জন কক্স এক্স-রে ব্যবহার করে ওই তরুণের পায়ে গুলি খুঁজে পান। এরপর ১৮৯৬ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নীল নদ অভিযানে যাওয়ার সময় এক্স-রে মেশিন সঙ্গে নিয়ে যায়।


এক্স-রে-র খ্যাতি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিখ্যাত হয়ে যান রন্টজেন। দেশে দেশে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০১ সালে তিনি পদার্থবিদ্যায় প্রথম নোবেল পুরস্কার পান। তিনি আরও অনেক সম্মান পান। তাঁর নামে রাস্তার নামকরণ করা হয়। রন্টজেন নিজে অবশ্য প্রচারের আড়ালে থাকতেই পছন্দ করতেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি কোনও ভাষণ দেননি। তিনি নিজের মতো করে গবেষণা চালিয়ে যেতেই ভালবাসতেন। তবে তাতে তাঁর খ্যাতি বিন্দুমাত্র কমেনি।