কলকাতা: অনেকসময়েই হয়তো এমন হয়। সারা দুনিয়া যখন কাউকে দুর্বল ভেবে দূরে সরিয়ে রাখে তিনিই পরে হয়ে ওঠেন ফিনিক্স পাখি। শুধু নিজেকেই প্রমাণ করে থেমে যান না। পথ দেখান তাঁর মতো অবহেলিত, উপেক্ষিত আরও অনেককে। আগামী ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস (International Women's Day 2024)। তার আগে এমনই এক লড়াকু নারীকে চেনা যাক। যাঁর নাম টিফানি ব্রার (Tiffany Brar)। প্রতিবন্ধকতাতে তিনি তাঁর বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেননি। বরং সেখান থেকেই এনেছেন লড়াইয়ের শক্তি।
উত্তর ভারতীয় এক সেনা পরিবারে জন্ম হয়েছিল তাঁর। তারপরেই এমন দুর্ঘটনা ঘটে যা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। অক্সিজেনের ওভারডোজের কারণে তাঁর দৃষ্টিশক্তি চলে গিয়েছিল। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, চিকিৎসায় গাফিলতির কারণেই এমনটা হয়েছিল। এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটলে অনেকেই ভেঙে পড়েন, কিন্তু টিফানি ব্রার (Tiffany Brar Life) অন্য ধাতুতে গড়া। এই প্রতিবন্ধকাতেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন তিনি। আর তারপর? ধাপে ধাপে সব জয় করে উত্থানের কাহিনি। একাধিক সাক্ষাৎকারে টিফানি বলেছেন যে তিনি মনে করেন তাঁর সঙ্গে এমনটা হয়েছিল বিশেষ একটা কারণেই। সেই কারণটি না হলে আজ এমন ভাবে লড়াই করতে পারতেন না তিনি, এই জায়গায় এসে দাঁড়াতেও পারতেন না।
বাবা বিদেশে কর্মরত ছিলেন, সেই সূত্রেই প্রাইমারি স্তরে (Tiffany Brar Education) পড়াশোনা ব্রিটেনে হয়েছিল। সেখানে একজন বিশেষভাবে সক্ষম শিশু যেভাবে শিক্ষা পেতে পারে তার ব্যবস্থা ছিল। প্রাথমিক স্তরে কোনও সমস্যা হয়নি। তার কিছুদিন পরে ভারতে ফিরে আসে তার পরিবার। কিন্তু এখানে আধুনিক প্রযুক্তি থেকে পরিকাঠামো কিছুই ছিল না। একটি জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যমের একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে তিনি জানিয়েছেন এই কথা। তারসঙ্গেই তিনি ভাগ করে নিয়েছিলেন ছোটবেলার একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। একটি স্কুলে পড়তেন তিনি, তখন ৯ বছর বয়স তাঁর। কী সেই অভিজ্ঞতা? টিফানি বলছেন, 'শিক্ষক ক্লাসে জিজ্ঞেস করেছিলেন ভারতের রাজধানী কোথায়, আমার এক ক্লাসমেট বলেছিল কলকাতা। আমি সঙ্গে হাত তুলে বলি, ঠিক উত্তরটা নয়াদিল্লি। তখনই হঠাৎ রেগে যান ওই শিক্ষক। আমায় মুখ বন্ধ করতে বলেছিলেন। আমায় অন্ধ বলে ডেকেছিলেন। ক্লাস থেকে বের করেও দিয়েছিলেন। আমি অন্ধ বলে কি ঠিক উত্তর দিতে পারি না?' তখনই দিশা ঠিক করে নিয়েছিল তাঁর মন। ভবিষ্যতে যেন কোনও দৃষ্টিহীন বাচ্চাকে যেন এত অপমানিত না হতে হয়, শিক্ষা পেতে সমস্যা না হয়। ওই ছোটবেলা থেকেই টিফানির লড়াই শুরু।
ধীরে ধীরে কেরল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা। তারপর কোয়েম্বত্তূরের রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্পেশাল এডুকেশনে ডিগ্রি। ততদিনে তিনি ঠিক করে নিয়েছেন কোন পথে এগোবেন। বেশ কিছু ভাষাও রপ্ত করেছেন। দৃষ্টিহীনদের পদে পদে কী কী বাধার সম্মুখীন হতে হয় তা তিনি নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন। তাই তাঁর মতো বাকিদের যাতে সেই বাধার সামনে পড়তে না হয়-সেই লক্ষ্যেই শুরু করেন কাজ। প্রথমে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে কাজ শুরু করেন। বেশ কয়েকবছর হাতেকলমে কাজ করেন। এরপর ২০১২ সালে সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে দৃষ্টিহীনদের জন্য় একটি মোবাইল স্কুল শুরু করেন তিনি। সেটির মোটো ছিল- 'যদি কোনও দৃষ্টিহীন স্কুলে যেতে না পারেন, তাহলে তাঁর কাছে আসবে স্কুল'। মবিলিটি (Mobility) অর্থাৎ স্বনির্ভর ভাবে চলাফেরার জন্য ট্রেনিং, কথা বলার প্রশিক্ষণ থেকে ব্রেইল (Brail), আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার- এই সবকিছুর জন্য প্রশিক্ষণ দেন তিনি। ২০১৫ সালে তৈরি করেছেন তাঁর নিজের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা জ্য়োতির্গময় ফাউন্ডেশন (Jyothirgamaya Foundation)। এখন সেখানেই প্রশিক্ষণ নেয় বহু বিশেষভাবে সক্ষম নাগরিক। প্রযুক্তিভিত্তিক একাধিক ট্রেনিং দেওয়া হয়। Women Economic Forum-এর ওয়েবসাইট অনুযায়ী, তাঁর সংস্থায় প্রশিক্ষণ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন বহু ব্যক্তি। সেখানেই বলা হয়েছে বিনোদ নামে এক যুবকের কথা। যিনি দৃষ্টিহীন হওয়ার স্কুলের নাগাল পাননি। টিফানির সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ পান তিনি। এখন বিনোদ একজন Access technology বিশেষজ্ঞ এবং প্রশিক্ষক, পাশাপাশি একজন সাউন্ড ডিজাইনারও। শুধু প্রশিক্ষণই নয়, শারীরিক কসরৎ করা থেকে চলাফেরায় স্বনির্ভর হওয়া-সবটা হাতে ধরে পাশে থাকে টিফানির সংস্থা। দৃষ্টিহীন নাগরিক এবং বিশেষ করে দৃষ্টিহীন নারীদের সশক্তিকরণের কাজ করে যাচ্ছেন টিফানি ব্রার। আর মোটিভেশনাল স্পিকার (Tiffany Brar Motivational speaker) হিসেবে শক্তি জুগিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য ব্যক্তিকে।
মিলেছে স্বীকৃতি (Award got by Tiffany Brar):
রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পেয়েছেন বেস্ট রোল মডেল-এর জাতীয় পুরস্কার। এছাড়াও হলম্যান পুরস্কার, নারী শক্তি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন।
একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, কোনও পরিবারে যতক্ষণ না পর্যন্ত কোনও সদস্য এমন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়ছেন ততক্ষণ হয়তো সেই যন্ত্রণা উপলব্ধি করা যায় না। আর তিনি তো নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন কাঁটা বিছোনো পথের যন্ত্রণা। তাই সেই পথের কাঁটা উপরে গোলাপ বিছোনোর মতো কঠিনতম কাজটাই (Disability Rights Advocate) বেছে নিয়েছেন নিজের লক্ষ্য হিসেবে।
আরও পড়ুন: বারবার তাঁর কাছে হেরেছে মৃত্যু! হুইলচেয়ার সঙ্গী করেই মডেলিং, সামাজিক লড়াইও