সোমনাথ মিত্র, হুগলি: চার হাত বিশিষ্ট অভয়া মূর্তি এখনও খুব জাগ্রত। ষষ্ঠীতে অধিবাসের পর ঠাকুর দালানে মাকে একা রাখা যায় না। কমপক্ষে পরিবারের দুজন সদস্য মায়ের সাথে রাত্রি যাপন করেন। এবং রাতে গা ছমছমে পরিবেশে ,এখনও অনুভব করেন নুপূর পায়ে যেনও কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছেন। ২৯৩ বছরের প্রাচীন জমিদার বাড়ির এই পুজোর একাধিক অলৌকিক ঘটনার কথা শোনালেন বর্তমান প্রজন্মের এক তরুণী।
শারদ উৎসব শুরু হতে আর কয়েকদিন বাকি। অতিবৃষ্টির পর নীল আকাশে এখন সাদা মেঘের ভেলা। জলাশয়ের পাশে হাওয়ায় দুলছে কাশফুল। সর্বত্রই উৎসবের প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে। বারোয়াড়ির পাশাপাশি বাড়ির পুজোতে ও চলছে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। হরিপাল থানার নালীকুল বড়গাছিতে ২৯৩ বছরের প্রাচীন সিংহ, বসু মল্লিক ও রায় পরিবারের পুজো ঘিরে পরিবারের সদস্যদের ব্যস্ততা চরমে। পুজোর আয়োজনে যেনও কোনও খামতি না থাকে তা নিয়ে বৈঠক চলছে ঠাকুন দালানে। এখনও প্রাচীন রীতিনীতি ও ঐতিহ্য বজায় রেখে নিষ্ঠার সঙ্গে দেবীর আরাধনা করে থাকেন এই তিনটি পরিবার।
সিংহ, বসু মল্লিক ও রায় পরিবারে মা অভয়া রূপে পুজিত হন। চার হাত বিশিষ্ট দেবীর গায়ের রঙ তপ্ত কাঞ্চন। মায়ের বাঁদিকের উপরের হাতে থাকে চক্র, নিচের হাতে সাপ, ডান দিকের উপরের হাতে খরগো নিচের হাতে ত্রিশূল। গুপ্ত পঞ্চিকা মতে আরাধনা হয় দেবীর। পাঁচ খিলান যুক্ত ঠাকুর দালান। মন্দিরের মাথায় ত্রিমুখী তিনটি ত্রিশুল মাঝে চক্র। একই কাঠামোতে বছরের পর বছর ধরে তৈরি হচ্ছে প্রতিমা। দশমীতে বিসর্জনের পরেই মাটি কিছুটা ধুয়ে গেলে তুলে আনা হয় কাঠামো। মন্দির দালানে সেই কাঠামো রেখে শান্তি জল দেওয়া হয়। তারপর সাদা কাগজে লাল কালী দিয়ে শ্রী শ্রী দুর্গা মাতা সহায় লেখেন পরিবারের সকলে। প্রাচীনকাল থেকে এমনই চলে আসছে। সপ্তমী, অষ্টমীর সন্ধিক্ষণপুজো ,ও নবমীতে ছাগ বলির পাশাপাশি ফল বলিও দেওয়া হয়।
ঠাকুর মন্দিরে প্রবেশ পথের বাঁ দিকে রয়েছে বংশের প্রাচীন শিব মন্দির। আর ডান দিকে অর্থাৎ মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকে সোজাসুজি রয়েছে বংশের প্রাচীন রাসমঞ্চ ও আরও একটি শিব মন্দির । মন্দিরের পিছনে রয়েছে নারায়ন ঘর। নিত্য পুজো হয় সমস্ত ঠাকুরের। একই বংশের পুরোহিত পুজো করে আসছেন সমস্ত দেব দেবীর। হুগলির দামোদর নদের ওপার থেকে এখনো এক ই বংশের ঢাকীরা আসেন ঢাক বাজাতে। প্রতিমাও তৈরী করেন প্রাচীন কালের শিল্পীদের বংশধর। ডাকের সাজ ও দিয়ে যান প্রাচীন কালের সোলা শিল্পীদের বর্তমান শিল্পীরা । নবমী রাতে ঢাকীদের বিশেষ রঙ বাজনা দেখতে এলাকার অনেক মানুষ সমবেত হন মন্দির চত্বরে।। হাঁড়ি কাঠ বসে গেলে বাড়ির বিধবা মহিলারা কেউ ভাত খান না। দুর্গার পাশাপাশি দোল পূর্ণিমায় নারায়ন এনে পুজো করা হয় । রাস পুজো, চাঁচোর ইত্যাদি প্রাচীন পুজো এখনও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে মন্দির চত্বরে।
বংশের এক প্রবীন সদস্য অসীম সিংহ জানান, বোধন শুরু হয়ে গেলে বাড়ির কেউ ক্ষার দিয়ে জামা কাপড় কাচতে পারেন না। একবার বোধনের পর কেউ পুকুরে কাপড় ধুচ্ছিলেন। তখন এক মহিলা এসে বলেন সিংহ বাড়ির পুজো শুরু হয়ে গেছে তোরা এখনো কাপড় ধোয়ার কাজ করছিস। বলেই সেই মহিলা অদৃশ্য হয়ে যায়। সেই থেকে বোধন বসে গেলে সাবান কাঁচা,ক্ষার কাঁচা বন্ধ। দশমীতে বিসর্জনের পর ক্ষার কাঁচা হয়।
আরও পড়ুন, 'অভয়ার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই', জুনিয়র ডাক্তারদের ডাকে মিছিলে জনজোয়ার
বর্তমান প্রজন্মের সদস্যা সৌমিলী সিংহ জানান, ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত বাড়িতে প্রচুর লোক। অনেক হই হুল্লোর হয়। তা নিয়েই মেতে থাকি। কোন প্যান্ডেলে যাওয়া হয় না। সেই উল্টো রথের দিন কাঠে ঘা দিয়ে প্রতিমা তৈরীর কাজ শুরু হয়। তার পর এক মেটে ,তিন মেটে সমস্ত কিছুই ঠাকুর দালানে বসে বসে দেখি ও খুব উপভোগ করি। কিছু ভিডিও তৈরী করি। অষ্ঠমীর সন্ধি পুজো বা নবমীর হোমের সময় মায়ের দিকে তাকানো যায় না। যেন মনে হয় মা জীবন্ত। নবমীতে যেন দেখা যায় মায়ের চোঁখের এক কোনও জল এসেছে, যেন ঠাকুর ভাবছেন এবার হয়তো বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। এতটাই জাগ্ৰত আমাদের অভয়া।
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।