সোমনাথ মিত্র, হুগলি: হাওড়া বর্ধমান কর্ড লাইনের সিঙ্গুর ব্লকের অন্তর্গত মির্জাপুর বাঁকিপুর স্টেশন। সেখান থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ জগৎনগর কালী বাড়ি। ৩০০ বছরের বেশী সময় ধরে সেখানে 'মা আনন্দময়ী 'কালী রূপে বিরাজমান । কথিত আছে, 'মা আনন্দময়ী' র নাম মনে- প্রাণে  জড়িয়ে নিলে আর কোনও ক্ষতি হবে না। এই বিশ্বাস,শ্রদ্ধা ও পরম্পরায়  গ্ৰামেরই মেয়ে 'মা আনন্দময়ী' কালী রূপে পূজিত হয়ে আসছেন (Kali Puja 2023)।


প্রাচীনকালে শ্মশানের  চিতার উপর তৈরী মন্দির। মঞ্চমুন্ডের আসনের উপর অধিষ্ঠিতা মা। পুরানো রীতি মেনে নিত্যপুজো হয় মায়ের।কালী পুজোয় সারাদিন বিশেষ পুজো অর্চনা হয় মন্দিরে। কালীপুজোর দিন সকাল থেকে দূর দূরান্ত থেকে আগত লক্ষাধিক ভক্তের ভিড়ে পূর্ণভূমিতে পরিণত হয় জগৎনগর কালী বাড়ি। 


শোনা যায়, নানান মন কামনা নিয়ে মায়ের মন্দিরে ধর্না দিলে এখনও মায়ের নির্দেশে মেলে প্রতিকার। মা‌য়ের মহিমার কথা তাই লোকের মুখে মুখে ঘোরে। প্রতিকার মেলে কঠিন ব্যাধি থেকে, সন্তানের পড়াশোনা কিংবা কর্মক্ষেত্রে উন্নতি , বা সন্তান না হওয়া দম্পতির মুখে  হাঁসি ফোটান 'মা আনন্দময়ী।' মির্জাপুর বাকিঁপুর অঞ্চলের কোন বাড়ির যে কোনও শুভ অনুষ্ঠান হোক কিংবা বাড়িতে কোনও পুজো এমনকি কালীপুজো হলেও আগে এলাকার মানুষ জগৎনগর কালী বাড়িতে 'মা আনন্দময়ী'র কাছে পুজো নিবেদন করেন। তারপর যে কোনও অনুষ্ঠান বা পুজোপাট শুরু করেন। 


কথিত আছে, ৩০০ বছর আগে জগৎনগর গ্রামের  সুবল রায়ের কন্যা 'আঁন্দি' কিশোরী বয়সেই মারা যায়। এলাকা তখন ঘন জঙ্গলে ভরা। কানা নদীর শাখা বয়ে গেছে এলাকা দিয়ে। তার পাশের শ্মশানে দাহ করা হয় 'আঁন্দি'কে। সেই দিন ঝড়-জলের রাতে গ্ৰামের মেয়ে 'আঁন্দি' পাশের গ্রামের এক কালী সাধককে স্বপ্ন দেন তিনি এখানে অধিষ্ঠিতা হয়েছেন এবং তাঁকে যেনও সে নিত্য পুজো করেন। সেই মতো সেই সাধক জগৎনগর গ্ৰামে গিয়ে চিতার উপর ঘট স্থাপনা করে বাঁশের বেড়া দিয়ে গ্ৰামের মেয়ে 'আঁন্দি'কে মাতৃরূপে পুজো করা শুরু করেন।


অনেক দিন পরে মাটির মন্দির তৈরি হয়। ইতিমধ্যে সিঙ্গুরের পলতাগড় নিবাসী ব্রাহ্মণ দীগম্বর চক্রবর্তী যিনি কাশীতে পুজো অর্চনায় লিপ্ত ছিলেন তাঁকে মা স্বপ্নাদেশ দেয়, তাঁর পুজোর দায়িত্ব নিতে। কাশী থেকে তড়িঘড়ি ফিরে দীগাম্বর চক্রবর্তী 'মা আনন্দময়ী'-র  নিত্যপুজোর  দায়িত্বগ্ৰহণ করেন। এখনও তাঁর বংশধরেরাই মায়ের নিত্য পুজো করে আসছেন প্রাচীন রীতি নীতি মেনে। পরবর্তীকালে ১২৮৪ সালে এলাকার বাসিন্দা কৈলাশচন্দ্র দত্ত মায়ের মন্দির তৈরি করেন। এবং বেনারস থেকে কষ্ঠি পাথরের মূর্তি এনে প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে একই  মূর্তি পুজিত হয়ে আসছে মায়ের মন্দিরে।। পরবর্তীকালে সেই জরাজীর্ণ মন্দির সংস্কার করেন গ্ৰামবাসীরা। বাংলার ১৪১২ সালের ২৭শে মাঘ দক্ষিনেশ্বর মন্দিরের আদলে  মায়ের নবনির্মিত মন্দিরে 'মা আনন্দময়ী'কে পুনরায় প্রতিষ্ঠা‌ করা হয়। মূর্তি একই। সেই কারণে প্রত্যেক বছর মায়ের বাৎসরিক পুজো পাঠ,হোম যজ্ঞ ও অন্নকোটৎসব পালিত হয় ঘটা করে। 


'আঁন্দি' নামক যে মেয়ে পূজিত হন। গ্ৰামে  সেই বাড়ির প্রবীন বংশধর জয়দেব রায় জানান, গভীর রাতে মা প্রত্যেহ জাগ্ৰত হন এবং মন্দিরের পাশের পুকুরে স্নান করতে যান। তাই গভীর রাতে মন্দির চত্বরে এমন এক পরিবেশ তৈরী হয় যে, সেখানে কেউ থাকতে পারে না। বছর দশেক আগের ঘটনা, রাত পাহারাদারদের ওখানে থাকতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু সেই নির্দেশ অমান্য করে পাহারাদাররা রাতে মায়ের পুকুরের সামনে ছিল।আচমকাই মন্দিরের পাশে একটি  বাঘ ঘোরাফেরা করছে দেখতে পায় তাঁরা। ভয়ে সবাই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বাঁচে। এইরকম "মা আনন্দময়ী "কে নিয়ে নানা মহিমার কথা শোনা যায়।


আরও পড়ুন, অভিষেকের বিরুদ্ধে 'ডায়মন্ডহারবার' কেন্দ্রে নৌশাদ ? কী বললেন TMC-র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক


মন্দিরের এক  পুরোহিত শুকদেব চক্রবর্তী বলেন, কালী পুজোয় সারাদিন সারারাত পুজো চলে, পরের দিন হোম যজ্ঞ হয়ে পুজো শেষ হয়। সবাই এখানে এসে মাকে পুজো দেন। এখানে কোনও বাড়িতে যে কোনও অনুষ্ঠান বা যদি পুজো হয়, তাহলে মায়ের কাছে আগে পুজো দিয়ে যায়। এমনকি কোনও শব দাহকর্ম করার জন্য যাবার আগে মায়ের মন্দিরের সামনে একটু দাঁড়িয়ে নাম সংকীর্তন করে তারপর রওনা তাঁরা শব নিয়ে রওনা দেয়। 'মা আনন্দময়ী'কে এতটাই শ্রদ্ধা করে এলাকার মানুষ। মা সবার ইচ্ছাপূরণ করেন।