করুণাময় সিংহ, মালদা: পুনর্ভবা নদীর এপার। মালদার হবিবপুর থানার জাজইল গ্রাম পঞ্চায়েতের মানিকোড়া গ্রাম। এখানে যে কালীপুজো হয়, কথিত রয়েছে এই পুজো অন্তত তিনশো বছরের পুরনো। এই পুজো নাকি করত ডাকাতরা। তখন জঙ্গলে ঘেরা ছিল মানিকোড়া। সেখানেই এই দেবীর পুজো দিতে আসত ডাকাতরা। রাতের অন্ধকারে পুনর্ভবা নদী পেরিয়ে মানিকোড়ায় আসত ডাকাতরা। সূর্য ওঠার আগেই পুজো দিয়ে আবার নিজেদের ডেরায় ফিরে যেত ডাকাতরা। তারপর সময় বয়েছে, নিয়ম বদলেছে কিন্তু পুজোটা রয়ে গিয়েছে। তবে লোকশ্রুতি অনুযায়ী ডাকাত দলের প্রথা মেনেই এখনও মশাল জ্বালিয়ে পুজো হয় এখানে।


ব্রিটিশ আমলে নাকি স্থানীয় এক জমিদার জঙ্গলে ঘেরা এই পরিত্যক্ত পুজোর বেদি খুঁজে পান। এরপর থেকে বংশপরম্পরায় জমিদারদের উদ্যোগে এই পুজো হয়। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার পর গ্রামবাসীদের উদ্যোগে মালদার হবিবপুর থানার জাজইল গ্রাম পঞ্চায়েতের মানিকোড়া এলাকায় এই কালী পুজো হয়ে আসছে। এই পুজো কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক সজল কুমার রায় বলেন, 'এই পুজো নিয়ে অনেক গল্প কথা রয়েছে। পুনর্ভবা নদীর ওপারে বর্তমান বাংলাদেশ থেকে রাতের অন্ধকারে ডাকাতদল এই দেবীর পুজো দিতে আসত। ডাকাত দলের আনাগোনা বন্ধ হলে স্থানীয় জমিদার জঙ্গলে ঢাকা এই পুজোর স্থান খুঁজে পেয়ে পুজো শুরু করেন। বর্তমানে গ্রামবাসীরা এই পুজো করেন।' পুজো ঘিরে মেলা বসে। সাতদিন ধরে মেলা চলে বলে জানাচ্ছেন আয়োজকরা। এই পুজোয় নাকি আগে মোষ বলি হতো, এখন আর মোষ বলি না হলেও রাতভর নাকি চলে পাঠা বলি।


এই পুজোর সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে লোককথা। কথিত রয়েছে, কোনও এক সময় গ্রামে শাখা ফেরি করতে এসেছিলেন এক শাঁখারী। গ্রামের পথে এক মেয়ে তাঁর কাছে শাঁখা পড়তে চাই। শাঁখারী তার হাতে শাখা পরিয়ে দেন। কিন্তু দাম চাইতেই সে নাকি বলে, তার কাছে পয়সা নেই ,শাঁখার দাম তার বাবা দেবেন। কালী মন্দিরের সেবায়েতকে তার বাবা বলে সম্বোধন করেছিল ওই মেয়ে। শাঁখারী কালী মন্দিরে গিয়ে সেবায়েতের কাছে শাঁখার দাম চাইতেই অবাক হয়ে যান ওই সেবায়েত। তিনি নাকি বলেছিলেন তাঁর কোনও মেয়ে নেই। তখনই তাঁর নজর যায় পাশের পুকুরের দিকে। তখন নাকি ওই সেবায়েত দেখতে পান যে জলের ওপরে একটি মেয়ে দুই হাত উঁচু করে রয়েছে। দুটি হাতে রয়েছে একজোড়া নতুন শাখা। মুহূর্তেই সেবায়েত বুঝে যান ওই মেয়ে আর কেউ নন স্বয়ং মা কালী। মুহূর্তের মধ্যেই শাখার দাম মিটিয়ে দেন তিনি। লোকমুখে শোনা যায়, পুজোর গভীর রাতে চক্ষুদানের পাঁঠা বলির  সময় এই দেবীমূর্তি কেঁপে উঠে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়তেন। সেই কারণে নাকি আগে দেবী মূর্তিটি লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার প্রচলন ছিল। এখন চক্ষুদান ও পাঠা বলির সময় দেবীর মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়।


স্থানীয় বাসিন্দা মৃণ্ময় রায় জানিয়েছেন দেবীর মাহাত্ম্যের নানা কাহিনী মানুষের মুখে মুখে ফেরে। পুরনো রীতি মেনে এখনো মশাল জ্বালিয়ে মায়ের পুজো করা হয় এখানে। পুজোর কয়েকটা দিন গোটা এলাকার মানুষ নিরামিষ খেয়ে থাকেন। বহু মানুষ এখানে মানত করে পুজো দিতে আসেন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত এমনকী ভিনরাজ্য থেকেও ভক্তরা পুজো দিতে আসেন এই মন্দিরে। গ্রামের যে কোনও শুভ অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে এখনো দেবীর পুজো দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে।


আরও পড়ুন: অন্য পুজো হলেই রুষ্ট হন দেবী? গোটা গ্রামেই একটি মন্দিরেই পূজিতা কালী