কল্পতরু। ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে প্রার্থনা জানানোর দিন। ভক্তের মনস্কামনা পূর্ণ করার দিন ৷ পুরাণ বলে, ইন্দ্রের উদ্যানের পারিজাত বৃক্ষই ‘কল্পতরু’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ সেই বৃক্ষ, যার কাছে ভালো-খারাপ, যা চাওয়া যায়, তা-ই মিলবে। তাহলে নতুন বছরের প্রথম দিনটাই কেন হয়ে উঠল রামকৃষ্ণ ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত মানুষের কাছে কল্পতরু দিবস ? আসলে ১৮৮৬ সালের ঠাকুর শ্রী পরমহংসদেব তাঁর ভক্তদের কাছে কল্পতরু বৃক্ষের মতোই আবির্ভূত হয়েছিলেন। ভক্তদের দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন। এমনভাবে আগে ঠাকুরকে দেখেননি কেউ। এদিন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে কল্পতরু রূপে ভক্তদের আশীর্বাদ করেছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ৷   ভক্তদের আশীর্বাদ করে বলেছিলেন- ‘চৈতন্য হোক’৷ এরপর থেকেই প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনে পালিত হয়ে আসছে কল্পতরু উৎসব হিসেবে৷  

Continues below advertisement

কী ঘটেছিল সেদিন? 

১৮৮৬ সালের ১৬ অগাস্ট শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব ইহলোক ত্যাগ করেন। সেটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ পয়লা জানুয়ারি। ঠাকুর তখন রোগভোগে শীর্ণ। কর্কটরোগ জাঁকিয়ে বসেছে শরীরে। তাঁকে দেখতে ভক্তদের ঢল নেমেছে উদ্যানবাটীতে। গিরীশ ঘোষ সহ প্রায় জনা তিরিশের গৃহী ভক্ত সেদিন হাজির ছিলেন উদ্যানবাটীতে। ঠাকুর এলেন তাঁদের দর্শন দিতে। শরীর ভাল না।

Continues below advertisement

শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুর বাগানে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তারপর দুপুর-বিকেল করে শরীরটা একটু ভাল লাগায়, তিনি আস্তে আস্তে উঠে নিচে নামলেন। বাগানে দিকে এলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের পরনে সেদিন সরু লাল পাড় ধুতি,শার্ট,সবুজ কোট, চাদর, মাথায় সবুজ কানঢাকা টুপি।  লাটু মহারাজ এবং রামলালের সাহায্যে আস্তে আস্তে নেমে এলেন কাঠের সিঁড়ি দিয়ে।  পশ্চিম দরজা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানের দিকে হাঁটতে লাগলেন।  ছুটির দিন , তাই এদিন আগত ভক্তের সংখ্যা ছিল একটু বেশিই। তাঁরা নিজেদের মধ্যে ঠাকুরকে নিয়েই কথা বলছিলেন। সকলেই চিন্তিত তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে। সবাই তাঁকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম করলেন। ঠাকুর ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। 

বাড়ি ও ফটকের মাঝামাঝি পথে পৌঁছএ একটু দাঁড়ালেন।   পশ্চিম পাশে একটি গাছের নিচে ছিলেন গিরীশ ঘোষ। ঠাকুর জিগ্য়েস করলেন,  'আচ্ছা, গিরীশ, তুমি আমার মধ্যে কী দেখেছ যে, তুমি আমাকে সকলের সামনে ঈশ্বরের অবতার বলো?'তিনি তখন পরমহংস দেবের  সামনে নতজানু হয়ে হাত জোড় করে বসে পরেন। আবেগে কণ্ঠস্বর কাঁপছে ...বললেন, 'যাঁর মহিমা ব্যাস বা বাল্মীকির মতো ঋষিরাও যথাযথভাবে পরিমাপ করতে পারেননি তাঁর সম্পর্কে আমার মতো একজন তুচ্ছ ব্যক্তি কী বলতে পারেন?' উত্তরে ঠাকুর স্থির তাকিয়ে রইলেন, তাঁর পুরো মুখ স্বর্গীয় আনন্দে উদ্ভাসিত। গুরুর সেই অপূর্ব রূপ দেখে ভক্তদের আনন্দের সীমা রইল না। তাঁরা বলতে লাগল, 'জয় শ্রী রামকৃষ্ণ, জয় শ্রী রামকৃষ্ণ - শ্রী রামকৃষ্ণের জয়!'শ্রীরামকৃষ্ণ দিব্য হাসি হেসে বললেন: 'আর কী বলব? আমি তোমাদের সবাইকে আশীর্বাদ করি, তোমাদের চৈতন্য হোক!' এই কথাগুলি বলার পর ভাবাবিষ্ট হলেন ঠাকুর।   ভক্তরা বলতে শুরু করলেন , 'ওরে, কে কোথায় আছিস? শিগগির ছুটে আয়! ঠাকুর আজ কল্পতরু হয়েছেন।'  সেই থেকে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে ইংরেজি নববর্ষের দিন পালিত হয়ে আসছে কল্পতরু দিবস।

শ্রী রামকৃষ্ণ এই দিনে তাঁর ভক্তদের হৃদয়ে আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছিলেন মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যেতে, বন্ধন থেকে মুক্তির পথ দেখাতে। তাই তিনি ভক্তদের আশীর্বাদ করেছিলেন, 'আলোকিত হও, তোমাদের চৈতন্য হোক'। এই দিনে, গুরু অবতার রূপে সকলের সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁদের ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন এবং হৃদয়ে জ্ঞানের আলো সঞ্চার করেছিলেন। 

মনে করা হয়, ঈশ্বর সর্বদা কল্পতরু। যদি ভক্তরা প্রতিদিন,আন্তরিকতার সঙ্গে ধ্যান করেন, তবে ঠাকুর প্রতিদিন কল্পতরু হিসাবে উপস্থিত হবেন।