কলকাতা: প্রাচীন ভারতের প্রাগজ্যোতিষপুরই হল আজকের কামাখ্যা (Kamakhya Temple)। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ৩ শিখরের ওপর দেবী কামাখ্যার অধিষ্ঠান। গোটা নীলাচল পর্বতজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে দশমহাবিদ্যার মন্দির। কালিকাপুরাণ মতে, পীঠের সংখ্যা ৪। আবার দক্ষযজ্ঞের কাহিনী অনুসারে, পীঠের সংখ্যা ৫১। তবে পীঠের সংখ্যা যাই হোক না কেন, কামাখ্যা সবক্ষেত্রেই উল্লেখ্য। তাই একে শ্রেষ্ঠ পীঠ বলা হয়। 


‘কামেশ্বরীং যোনিরূপাং মহামায়াং জগন্ময়ীম’ তন্ত্রে কামাখ্যা মন্দির তৈরি নিয়েও নানা মত আছে।  কামাখ্যা মন্দির থেকে একটু ওপরে উঠলে রয়েছে বগলামন্দির। তন্ত্র বা গুপ্তবিদ্যা চর্চায় এই মন্দিরের যথেষ্ট নাম আছে। প্রতি মঙ্গলবার গুয়াহাটিতো বটেই, এমনকী দেশের নানা প্রান্ত থেকে মনস্কামনা পূরণের জন্য বহু মানুষের সমাগম হয় এখানে। 


কামাখ্যা মন্দির ও ব্রহ্মপুত্র নদ বরাবরই মানুষের বিশ্বাস ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তবে একই সঙ্গে এটি অলৌকিক এবং রহস্যে পরিপূর্ণ। মনে করা হয়, ঋতুস্রাবের সময় দেবীর রক্ত প্রবাহিত হওয়ার কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের জলও লাল হয়ে যায়। তবে এর সঙ্গে বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাস যুক্ত রয়েছে।


ধর্মীয় সাহিত্য অনুযায়ী আদি মন্দিরটি কামদেব দ্বারা নির্মিত, যিনি এই মন্দিরে মায়ের আরাধনা করার পর শিবের বরপ্রাপ্ত হয়ে তাঁর স্বকীয় সৌন্দর্য ফিরে পেয়ে ছিলেন। বিশ্বকর্মার সাহায্যে নির্মিত এই মন্দিরটি. স্থাপত্য এবং ভাস্কর্য বিস্ময়ে পর পূর্ণ। আবার এও বিশ্বাস করা হয়, এই মন্দির এমন একটি স্থান, যেখানে মহাদেব আর সতীর মিলন-সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সংস্কৃত শব্দ ‘কাম’ প্রেমের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে এই অঞ্চলটির নাম কামাখ্যা হয়েছে বলে অনেকের ধারণা ।


আরও পড়ুন, পড়েছিল সতীর ব্রহ্মরন্ধ্র, এখানে পাপস্খালন করেছিলেন স্বয়ং রামচন্দ্র, পড়ুন মরুতীর্থ হিংলাজ কথা


কালিকাপুরাণ অনুযায়ী জানা যায় যে মাতা সতীর পিতা প্রজাপতি দক্ষরাজ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন। শিব বিদ্বেষী দক্ষরাজ এই যজ্ঞে সতী ও শিবকে নিমন্ত্রণ করেন না। সেই সময় শিব ও সতীর মধ্যে মনোমালিন্য হয় যজ্ঞকে কেন্দ্র করে। পরবর্তী সময়ে শিবের অনুমতি নিয়ে সতী যজ্ঞ স্থানে আসেন। কিন্তু দক্ষরাজ শিবসহ সতীকে অপমান করেন। স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে যজ্ঞকুণ্ডের আগুনে আত্মহুতি দেন দেবী সতী। সতীহারা শিব প্রচন্ড রাগে সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। সমস্ত সৃষ্টিকে বাঁচতে ও সমস্ত দেবতার অনুরোধে বিষ্ণুদেব তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খন্ড খন্ড করে ৫১ টি অংশে বিভক্ত করেন। পরবর্তীকালে সতীর দেহের ৫১ টি অংশ বহু স্থানে পড়ে তৈরি হয় আদি শক্তির পীঠস্থান। কামাখ্যার নীলাচল পাহাড়ে পড়ে এই অংশটি কালক্রমে প্রস্তরীভুত হয় ও এখানে পুজো করা হয়। 


কামাখ্যা মাকে সবাই তন্ত্র সাধনার দেবী বলেন। তাই তন্ত্র সাধনার মূল স্থান কামরূপ কামাখ্যা মন্দির। এই মন্দিরে দশমহাবিদ্যার মাতঙ্গী ও কমলা রূপটিরও পূজা হয় আর গর্ভগৃহের বাইরে মার বাকি মহাবিদ্যার মন্দির রয়েছে।


প্রতি বছর জুন মাসে ব্রহ্মপুত্র নদের জল তিন দিন রক্তের মতো লাল হয়ে যায়। মনে করা হয়, এই সময়ে কামাখ্যা দেবী মাসিক চক্রে বাস করেন। রজস্বলার সময়, দেবী কামাখ্যার প্রবাহিত রক্তে সমগ্র ব্রহ্মপুত্র নদর জল লাল হয়ে যায়। কামাখ্যা দেবীর মন্দিরে শুধু পূজার নিয়মই নয় অন্যান্য মন্দিরের থেকে আলাদা। বরং এখানে ভক্তদের প্রসাদও দেওয়া হয় ভিন্নভাবে। এখানে প্রসাদ হিসেবে ভক্তদের লাল রঙের কাপড় দেওয়া হয়। এই লাল কাপড় সম্পর্কে বলা হয় যে, যখন দেবীর ঋতুচক্র তিন দিন থাকে, তখন মন্দিরে সাদা রঙের কাপড় বিছিয়ে তিন দিন মন্দির বন্ধ থাকে। তিন দিন পর মন্দিরের দরজা খুললে দেবীর রক্তে সাদা কাপড় লাল হয়ে যায়। এই কাপড়টিকে অম্বুবাচী কাপড় বলা হয় এবং ভক্তদের প্রসাদ হিসাবে দেওয়া হয়।