কলকাতা: ঋগ্বেদে যে ত্বষ্টাকে পৃথিবীর স্রষ্টা বলা হয়েছে, সেই ভাবনা অনুসৃত হয়েছে পুরাণেও। অবশ্য বায়ু পুরাণে ত্বষ্টার পরিবর্তে বিশ্বকর্মা নামেই এই জগতস্রষ্টা প্রজাপতিকে সম্বোধন করা হয়েছে। বিশ্ব সৃষ্টি করেন বলেই বিশ্বকর্মা। সৃষ্টির আদিতে তিনি কীভাবে পৃথিবীর স্থলভাগ এবং জলভাগের বিভাগ করেছিলেন, তারপর ধীরে ত্বষ্টা, ধীরে ধীরে কীভাবে পর্বত অরণ্য সমৃদ্ধ পৃথিবী নির্মিত হল, জীবকুলের বাসযোগ্য হয়ে উঠল বিশ্বকর্মার পত্নীৰ নিপুণ শিল্পকর্মে পুরাণে তার বিবরণ পাওয়া যায়।
দেবশিল্পীকে বিশ্বকর্মা নামেই উল্লেখ করা হয়েছে পুরাণে। রামায়ণে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে বিশ্বকর্মা যাবতীয় দিব্যাস্ত্রের নির্মাতা। এই সকল অস্ত্র তিনি মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে দান করেন। বিশ্বামিত্রের কাছ থেকে রামচন্দ্র সেই সব দিব্যাস্ত্র লাভ করেন। পুরাকালে দক্ষিণ সমুদ্রের অন্তর্গত দ্বীপে অলৌকিক সুন্দর লঙ্কানগরীর নির্মাতা বিশ্বকর্মা এমনটাই জানা যায়। বিশ্বকর্মারই পরামর্শে সুমালী, মাল্যবান প্রভৃতি রাক্ষসরা লঙ্কানগরীতে রাজধানী স্থাপন করেন। রাবণের ব্যবহৃত পুষ্পক বিমানও বিশ্বকর্মারই অলৌকিক কীর্তি।
পৌরাণিক শাম্মলদ্বীপে তিনিই গরুড়ের রত্নখচিত প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, একথা রামায়ণেও উল্লিখিত হয়েছে। ভরত যখন রামচন্দ্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য পরিবার ও প্রজাবর্গ এবং বিশাল সেনা সঙ্গে নিয়ে বনের অভিমুখে যাত্রা করেন, সেই সময় পথে একদিনের জন্য তাঁরা সকলে মহর্ষি ভরদ্বাজের আতিথ্য স্বীকার করেছিলেন। মহর্ষি ভরদ্বাজের অনুরোধে বিশ্বকর্মা সেসময় সকলের জন্য নানা ঐশ্বৰ্য্যমণ্ডিত অলৌকিক অস্থায়ী অতিথিশালা এবং খাদ্যপেয় ও নানা ভোগ্যদ্রব্যের আয়োজন করেছিলেন এক নিমেষে।
মহাভারতে উল্লেখ না থাকলেও ভাগবত শুক্রাচার্যের পুত্র বলেও উল্লেখ পুরাণ থেকে জানা যায়, কৃষ্ণের অনুরোধে এই বিবরণে অবশ্য দেখা পাণ্ডবদের জন্য ইন্দ্রপ্রস্থ রাজধানী নির্মাণ করেছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। দৈত্যরাজ বিরোচনের নির্মাণের অনেক আগেই কৃষ্ণ তথা যদুবংশীয়দের প্রহ্লাদের কন্যা) যশোধরার জন্য তিনি সমুদ্রতীরে অপূর্ব সুন্দর দ্বারকানগরীও নির্মাণ করেন বলে পুরাণে উল্লেখ পাওয়া যায়। মৎস্য পুরাণে তাঁকে বাস্তুশাস্ত্রের শিল্পী এবং শিল্পকর্মে যার দক্ষতা অন্যতম প্রণেতা বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
পণ্ডিতরা এই বিশ্বকর্মা শব্দটিকে ত্বষ্টা এবং ব্রহ্মার বিশেষণ হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি এই বিশ্ব সৃষ্টি করেন তাই তিনি বিশ্বকর্মা, তিনি সমস্ত প্রাণীর রূপ দান করেন, তাই তিনি বিশ্বরূপ। বস্তুত ঋগ্বেদিক ভাবনায় আদি স্রষ্টা প্রজাপতি যাকে ত্বষ্টা বা বিশ্বকর্মা বলা হয়েছে, তিনি সৃষ্টির পরিকল্পনা এবং নিপুণ শিল্পকর্ম —এই দুইয়েরই দায়িত্বপ্রাপ্ত।
পরবর্তীকালে পৌরাণিক ভাবনায় সৃষ্টির পরিকল্পনা তপস্যার ভার ন্যস্ত হয়েছে লোকপিতামহ ব্রহ্মার হাতে আর তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নিপুণ কারিগর হয়ে উঠেছেন বিশ্বকর্মা দেবশিল্পী। অগ্নিপুরাণে বিশ্বকর্মা দেবশিল্পীর মূর্তিনির্মাণ প্রসঙ্গে কিন্তু দেখা যাচ্ছে। প্রজাপতি ব্রহ্মার মতোই তাঁর হাতে অক্ষসূত্র। বঙ্গদেশে ছেনি-হাতুড়ি হাতে হস্তিবাহন বিশ্বকর্মা পূজিত হলেও সারাভারতে বিশ্বকর্মার যে মূর্তি পূজিত হয় তা হংসবাহন ব্রহ্মারই মূর্তি। ত্বষ্টা এই ব্রহ্মা- বিশ্বকর্মারই রূপান্তর বা নামান্তর মাত্র।
আরও পড়ুন, কোন সময়ে বিশ্বকর্মা পুজো করলে মিটবে সমস্যা, জেনে নিন দিনক্ষণ
তথ্যসূত্র-
বায়ু পুরাণ- ৬.৩৩-৪৫
ভাগবত পুরাণ
রামায়ণ ১.২৭.১৯