নয়াদিল্লি: হিমালয় দর্শনের পর, প্রকৃতির সামনে মানুষের ক্ষুদ্রতা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তোমার বিশাল ক্রোড়ে লভিতে বিশ্রাম-সুখ/ ক্ষুদ্র নর আমি এই আসিয়াছি ছুটিয়া’। কিন্তু সেই ক্ষুদ্র মানুষজাতিই এখন সুবিশাল হিমালয় পর্বতমালার অবক্ষয় ডেকে আনছে। কারণ তুষারগর্ভ হিসেবে যে হিমালয় পর্বতমালাকে এতদিন পৃথিবীর ‘তৃতীয় মেরু’ হিসেবে ধরা হতো, মানুষের কাজকর্মে তার অস্তিত্বই এখন সঙ্কটে। ব্ল্যাক কার্বনের প্রকোপে হিমালয়ের হিমবাহ ও তুষাররাশি গলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। (Black Carbon Impacts on Himalayas)
দিল্লির গবেষণা সংস্থা Climate Trends হিমালয় পর্বতমালার অস্তিত্ব সঙ্কটের কথা তুলে ধরেছে। আমেরিকার গবেষণা সংস্থা NASA-র স্যাটেলাইট তথ্যও খুঁটিয়ে দেখা হয়। আর তাতেই উদ্বেগ দেখা দিয়েছে গবেষকদের মধ্যে। Impact of Black Carbon on Himalayan Glaciers হিমালয়ের স্বাস্থ্য এবং তার উপর নেমে আসা সঙ্কটের কথা বিশদে তুলে ধরেছেন তাঁরা, যার জন্য গত দু’দশক ধরে চলে আসা মানুষের কার্যকলাপকে দায়ী করা হয়েছে। (Himalayan Glaciers)
গবেষকরা জানিয়েছেন, হিমালয় পর্বতমালাকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেল দিচ্ছে ব্ল্যাক কার্বন। বিশেষ করে, পূর্ব এবং মধ্যভাগে উচ্চ ঘনত্বের ব্ল্যাক কার্বন থাবা বসাতে শুরু করেছে। ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি ব্ল্যাক কার্বন সেখানে জমা হয়েছে সেখানে। এতে হিমালয় পর্বতমালার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বদলে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এশিয়ার ২০০ কোটি মানুষের জীবনে জলসঙ্কট নেমে আসতে পারে। তুষার গলতে শুরু করলে প্রথম দিকে বন্যার খাঁড়া নেমে আসবে যেমন, তেমনই হিমবাহগুলি একের পরে এক উধাও হতে থাকলে জলকষ্টে ভুগতে হবে সকলকে।
ব্ল্যাক কার্বন আসলে আলো শোষণকারী, সূক্ষ্ম ও কালো গুঁড়ো, যার মধ্যে রয়েছে কার্বন মৌল। বায়ুদূষণের সব উপাদান মজুত এতে। ডিজেল চালিত গাড়ি, কয়লা নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও বর্জ্য, রান্নার স্টোভ, কাঠের উনুন, জৈব জ্বালানি, জীবাশ্ম জ্বালানি, দাবানল থেকে ব্ল্যাক কার্বনের নির্গমন ঘটে পরিবেশে। সেই ব্ল্যাক কার্বন এখন হিমালয়কে দুর্বল করে দিচ্ছে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বরফের পুরু আস্তরণের নীচে হিমালয়ের যে মাটি, গত দু’দশকে তার তাপমাত্রাই প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছে। ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা ছিল -১১.২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০২০-২০২৩ সালের মধ্যে তা বেড়ে -৭.১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়েছে। গত ২৩ বছরের হিসেব যদি ধরা হয়, সেক্ষেত্রে সামগ্রিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ছিল -৮.৫৭° সেলসিয়াস।
গবেষকদের দাবি, ব্ল্যাক কার্বনের দরুণই হিমালয়ের এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি হয়েছে। হিমালয়ের মাটিতে যে হারে ব্ল্যাক কার্বন জমছে, তাতে হিমালয়ের মাটির রংই পাল্টে কালো হয়ে যাচ্ছে। কমছে প্রতিফলন শক্তি, যার দরুণ বেশি মাত্রায় সৌর বিকিরণ শোষণ করছে মাটি। এর ফলে মাটি যত গরম হচ্ছে, বরফও দ্রুত গতিতে গলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে হিমালয়ের তুষারও গলতে শুরু করবে বলে আগেই বিপদবাণী শুনিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু দিল্লির গবেষকদের মতে, ব্ল্য়াক কার্বন এই বরফ গলার গতিবৃদ্ধি করছে।
আশার আলো বলতে শুধুমাত্র ব্ল্যাক কার্বনের স্থায়ীত্ব। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহই বিরাজ করতে পারে ব্ল্যাক কার্বন। তাই হিমালয় পর্বতমালা অঞ্চলে কার্বনের নির্গমন কমানো গেলে, কয়েক বছরের মধ্যেই ফের শীতলতা ফিরে আসবে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। গবেষণাপত্রের মূল লেখক পালক বালিয়ান বলেন, “হিমবাহ দ্রুতগতিতে গলছে। ফলে বিশুদ্ধ জলের সঙ্কট দেখা দিতে পারে। পূর্ব হিমালয়ে ব্ল্যাক কার্বনের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। জৈববস্তুর দহন, জীবাশ্ব জ্বালানি এবং আবর্জনা পোড়ানোর ফলেই ব্ল্যাক কার্বনের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।” ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলকে তিনি কার্বন নির্গমনের ‘হটস্পট’ বলেও উল্লেখ করেন।
দিল্লিতে আয়োজিত India Heat Summit-এ সম্প্রতি বক্তৃতা করেন আন্তর্জাতিক পর্বত উন্নয়ন সংস্থার সিনিয়র ক্রায়োস্ফিয়ার স্পেশ্যালিস্ট ডঃ ফারুক আজম। বিশ্বব্যাপী হিমবাহের ভারসাম্য় নষ্ট হওয়ার জন্য ২০২২ সালকে বিশেষ ভাবে দায়ী করেন তিনি। জানান, ২০২২ সালে হিমাচলপ্রদেশের ছোটা শিগ্রির মতো হিমবাহগুলি অন্তত দু’মিটার করে বরফ হারিয়েছে। তাপপ্রবাহের জেরে কম প্রতিফলন শক্তি সম্পন্ন বরফের আস্তরণ বেরিয়ে যায় এবং গলনের গতি আরও বৃদ্ধি পায়। ওই বছর ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার সীমা অতিক্রম করে পৃথিবী। চার গুণ বেশি ক্ষতি হয় হিমবাহগুলির। হিমালয় পর্বতমালার পাশাপাশি সুইৎজারল্যান্ড এবং অস্ট্রিয়াতেও একই ছবি ধরা পড়েছে।
ডঃ ফারুক জানান, তাপমাত্রা যত বাড়়বে, ততই আকারে ছোট হতে থাকবে হিমবাহগুলি। নদীর জলে ক্ষতিকর উপাদান মিশবে আরও বেশি করে। ব্রহ্মপুত্রের জলস্তর ইতিমধ্যেই সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করেছে। হিমালয় পর্বতমালা অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। Climate Trends-এর ডিরেক্টর আরতি খোসলা জানিয়েছেন, রান্নারস্টোভ, ফসলের গোড়া পোড়ানো এবং যানবাহন থেকে ব্ল্য়াক কার্বনের নির্গমন ঠেকানো গেলে জলবায়ু পরিবর্তনকে অনেকটাই ঠেকানো যাবে, জলসঙ্কটের ঝুঁকিও সামাল দেওয়া যাবে। এর জন্য ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চল নির্দিষ্ট পরিকল্পনা কার্যকর করার কথাও বলেন আরতি।
অধ্যাপক তথা রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু পরিবর্তন সংস্থা Intergobernmental Panel on Climate Change-এর অঞ্জল প্রকাশ জানান, ব্ল্যাক কার্বন জমা হওয়ার ফলে মাটির প্রতিফল শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। এতে মাটি তপ্ত হয়ে উঠছে এবং হিমবাহগুলি মিলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। এই বিপদ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। সেক্ষেত্রে গার্হস্থ্য় জ্বালানি, কৃষি ও পরিবহণ ক্ষেত্রে লাগাম টেনে ধরতে হবে।