নয়াদিল্লি: বজ্র যে আসলে বিদ্য়ুৎ, তা ঢের আগেই প্রমাণ করে যান বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন। প্রাণ বাজি রেখে ঘুড়ির সঙ্গে চাবি বেঁধে নিজের চালিয়েছিলেন পরীক্ষা। কিন্তু এবার বজ্রকে লুফে নিয়ে অসাধ্যসাধন করল জাপান। সার্বিক ভাবে এই প্রযুক্তিকে কার্যকর করা গেলে, আগামী দিনে বজ্রপাত থেকে প্রাণহানি এবং সম্পত্তিহানি ঠেকানো যাবে বলে মত বিজ্ঞানীদের। এমনকি ভবিষ্যতে পৃথিবীর উন্নয়নেও কাজে লাগানো যেতে পারে বজ্রের শক্তিকে। (Controlling Lightning)

জাপানের টেলিকম জায়ান্ট Nippon Telegraph and Telephone (NTT) সংস্থা এই অসাধ্যসাধন করেছে। এক ধরনের বিশেষ ড্রোন তৈরি করেছে তারা, যার মাধ্যমে বজ্রকে লুফে নেওয়া হবে, ঘুরিয়ে দেওয়া হবে তার গতিপথ। আকাশেই গোটা প্রক্রিয়া মিটে যাবে। ফলে বজ্র আর বসতি এলাকায় আছড়ে পড়বে না। (Science News)

গোটাটাই গল্প বলে মনে হলেও, বাস্তবে ইতিমধ্যেই পরীক্ষা চালানো হয়েছে। ছোট আকারের ড্রোনগুলিতে লাগানো রয়েছে Faraday Cage. Faraday Cage আসলে একটি প্রতিরক্ষামূলক আবরণ, যার মাধ্যমে নিরাপদ পদ্ধতিতে বিদ্যুতের তরঙ্গ বাইরের দিকে প্রবাহিত হয় এবং  ড্রোনটি ঝলসে যায় না। আগের মতোই উড়তে থাকে ড্রোন। এক ধাক্কা সামলে অন্য কাজে হাত দেয়। 

তবে এক্ষেত্রে বজ্রপাতের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। বরং নিজে থেকেই বজ্রকে আকর্ষিত করে ড্রোনগুলি। বৈদ্যুতিক শক্তি সম্বলিত মেঘের মধ্যে সটান উড়ে যায় ড্রোনগুলি, এর পর বজ্রকে কার্যত প্রলুব্ধ করে তারা এবং নির্দিষ্ট দিকে পরিচালনা করে। Faraday Cage-এর কল্যাণে বজ্রের শক্তি ড্রোনের বাইরের দিকে সঞ্চারিত হয়। ফলে ভিতরের সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির কোনও ক্ষতি হয় না। 

এখনও পর্যন্ত পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, ১৫০ কিলো অ্যাম্পিয়ার্স বিদ্যুৎশক্তি সইতে সক্ষম ড্রোনগুলি, যা সাধারণ বজ্রপাতের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি শক্তিশালী। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বজ্রের আঘাত এড়িয়ে চলার পরিবর্তে, বজ্রকে নিজের দিকে প্রলুব্ধ করছে ড্রোনগুলি, যাতে বিপজ্জনক বিদ্যুৎশক্তিকে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।  

বজ্রকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এই প্রথম নয়। এমনিতে বজ্রপাত একটি অনিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক ঘটনা। এর জেরে প্রাণহানি থেকে সম্পত্তিহানি, দাবানল পর্যন্ত ঘটে। বিমানবন্দর, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, হাওয়াকলের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ড্রোনের মাধ্যমে বজ্রপাতকে অন্যত্র নিয়ে যেতে পারলে, সেই ঝুঁকি কমে যাবে অনেকটাই। শুধু বিপদ এড়ানোই নয়, ভবিষ্যতে বজ্রের বিপুল শক্তিকে বাক্সবন্দি করে মানবসভ্যতার উন্নয়নের কাজেও লাগানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে সেই বিপুল পরিমাণ শক্তিকে ধরে রাখা, সংরক্ষণ করে রাখার প্রযুক্তি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু বজ্রকে নিয়ন্ত্রণের এই যে কৌশল, তা ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করবে।

এই গোটা প্রক্রিয়ায় Faraday Cage-এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৩৬ সালে আবিষ্কৃত হয় Faraday Cage. বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গের উপর নির্ভরশীল আমরা। ওয়াইফাই, ব্লুটুথ, মোবাইল ফোনের 4G প্রযুক্তি, এই সবকিছুই বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ। এমনিতে এই তরঙ্গকে আটকানো যায় না। কিন্তু বিদ্যুৎ পরিবাহী ধাতব খাঁচা বা বাক্সের সাহায্য়ে তাকে বাইরের দিকে সঞ্চালিত করে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া যায়।  যে কারণে গাড়ির উপর বজ্রপাত ঘটলেও ভিতরে বসে থাকা যাত্রীরা সুরক্ষিত থাকেন। সেই একই পদ্ধতিতে বজ্রের আঘাত সয়েও আকাশে টিকে থাকছে ড্রোন। ব্রিটিশ পদার্থবিদ মাইকেল ফ্যারাডে এই পদ্ধতির আবিষ্কার করেন বলে তাঁর নামেই নামকরণ হয়েছে। 

বজ্রপাত নির্দিষ্ট কোনও দেশের সমস্যা নয়। আমেরিকা-সহ পৃথিবীর সর্বত্র বজ্রপাতের জেরে কোটি কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। ব্যাহত হয় বিমান পরিষেবা, বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে, দাবানলের প্রকোপ দেখা দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে বজ্রপাতের প্রকোপ দিন দিন বেড়ে চলেছে। পরিসংখ্যান বলছে,  প্রতি মিনিটে পৃথিবীর বুকে কমপক্ষে ৬০০০ বজ্রপাত ঘটে। তাই প্রকৃতিকে হারানো না গেলেও, তাকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় বের করেছে জাপানের NTT.