নয়াদিল্লি: ভয়ঙ্কর বিপদ নেমে আসতে পারে জাপানের বুকে। ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে যেতে পারে সবকিছু। প্রবল সুনামির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এখন থেকেই নাগরিকদের উদ্দেশে সতর্কবার্তা জারি করলেন বিজ্ঞানীরা। দেশের উত্তরের হোক্কাইদো দ্বীপটিই বিপর্যয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে জাপানে চিনের দূতাবাসের তরফেও নিজের দেশের নাগরিকদের সতর্ক করা হয়েছে। এমনকি ভূমিকম্প নিয়ে এই সতর্কতার পর ওই দ্বীপের পর্যটন ব্য়বসাতেও ভাঁটা পড়েছে বলে খবর। (Japan Mega Earthquake Alert)

জাপানে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে কয়েক মাস আগেই সতর্ক করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। গত ৩ জুন সেই নিয়ে নতুন ঘোষণা করেছে হোক্কাইদো প্রদেশ সরকার। ৭ থেকে ৯ বা তারও বেশি তীব্রতায় ভূমিকম্প আছড়ে পড়তে পারে দ্বীপটিতে। সেই সঙ্গে উঁচু তাণ্ডব চালাতে পারে সুনামি, যাতে জাপান সাগরের উপকূল এলাকার অন্তর্গত ৩৩টি পুরসভার প্রায় ৭৫০০ বাসিন্দা মারা যেতে পারেন। প্রাণহানি যাতে এড়ানো যায়, আগে থেকেই যাতে প্রস্তুত থাকা যায়, এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে বলে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, স্থলভাগের কাছাকাছিই চ্যুতিরেখাগুলি অবস্থান করছে। ফলে শেষ মুহূর্তে উদ্ধারকার্যে সমস্যা হতে পারে। (Japan Megaquake Alert)

গত সোমবার  পর পর ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে জাপানের হোক্কাইদোর বিস্তীর্ণ এলাকায়। প্রথমে ৬.৩ তীব্রতায় কম্পন অনুভূত হয়, তার ১৬ মিনিট পর, ভোর ৪টে নাগাদ ৪.৭ তীব্রতায় কেঁপে ওঠে মাটি। শনিবার রাতও ফের কেঁপে ওঠে জাপান এবং পর পর আরও কয়েক বার কম্পন অনভূত হয় গত কয়েক দিনে। রিখটার স্কেলে কম্পনের তীব্রতা কখনও ৪.৩, কখনও আবার ৬.১ ছিল। 

জাপান এমনিতেই ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হিসেবে গণ্য হয়। ভূমিকম্প এবং তার দরুণ উদ্ভুত সুনামি জাপানে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে আগেও সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা। সেই নিয়ে গত মার্চ মাসেই পাঁচ বছরব্যাপী একটি গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে। বিজ্ঞানীরা জানান, জাপান উপকূলের ঠিক উল্টো দিকে, সমান্তরাল ভাবে যে চিশিমা পরিখা রয়েছে, তার নীচে মাটির গঠন অত্যন্ত বিপজ্জনক। সেখানে প্রশান্ত মহাসাগরীয় টেকটোনিক পাতটি নর্থ আমেরিকান পাতের নীচে ঢুকে রয়েছে। ফলে একটি ২২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যুতিরেখার সৃষ্টি হয়েছে। একটু এদিক ওদিক হলেই ভূমিকম্পের তীব্রতা রিখটার স্কেলে ৯ ছুঁয়ে ফেলতে পারে। সুনামি আছড়ে পড়লে ঢেউয়ের উচ্চতা হতে পারে ২০ মিটার পর্যন্ত।

আবার হোক্কাইদোর পূর্বে কুরিল-কামচাটকা পরিখাও রয়েছে। আজ থেকে ৪০০ বছর আগে তীব্র ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ওই অঞ্চল। তাতে জলভাগের দিক থেকে একটি পাত স্থলভাগের দিকে প্রায় ২৫ মিটার সরে আসে বলে জানা যায়। সেই থেকে যদি বছরে ৮ সেন্টিমিটার করেও ওই পাতটি সরে আসতে থাকে স্থলভাগের দিকে, তাতেও তীব্র ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মত বিজ্ঞানীদের। 

তোহকু ইউনিভার্সিটি, হোক্কাইদো ইউনিভার্সিটি এবং জাপানের মেরিন-আর্থ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির গবেষকরা ২০১৯ সালেই সমুদ্রগর্ভে GPS অবজার্ভেশন পয়েন্ট বসাতে সফল হন, যার মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশের পরিস্থিতির উপর নজরদারি চলছে। এর আগে, ২০২২ সালে হোক্কাইদো সরকার জানায়, প্রশান্ত মহাসাগরের দিকটিতে যদি ভূমিকম্প হয় এবং তা থেকে সুনামি আছড়ে পড়ে, তার দরুণ কমপক্ষে ১ লক্ষ ৪৯ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে। যে কারণে চ্যুতিরেখা বিপর্যয় নিরসন টিমও গঠন করা হয়। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে তারা সক্রিয় রয়েছে। 

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য় অনুযায়ী, জাপান উপকূলে সাগরের নীচে কমপক্ষে ১৫টি বিপজ্জনক চ্যুতিরেখা রয়েছে। দিনের বেলা বিপর্যয় ঘটলে কী হতে পারে, রাতে হলে কী হতে পারে, গ্রীষ্মকালে ঘটলে কী হবে, শীতকালে কী পরিণতি হতে পারে— এমন ৯০ প্রকারের পরিকল্পনাও ছকে রাখা হয়েছে। শীতের রাতে তুষারপাতের মধ্যে বিপর্যয় ঘটলে ১৬০০০ বাড়ি ভেঙে পড়েতে পারে বলেও অনুমান করে রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন। হোক্কাইদোর উত্তরের ওয়াক্কানাই, হিরুতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা। 

তোহকু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফুমিয়াকি তোমিতার বক্তব্য “অল্প সময়ের মধ্য়ে পর পর ৫ ও ৬ তীব্রতায় বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হয়ে গিয়েছে। আতঙ্কিত না হয়ে পরিকল্পনামাফিক এগোতে হবে, মাটির নীচে কী ঘটছে, নজরদারি চালিয়ে যেতে হবে।” যে বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে, যে তীব্র ভূমিকম্পের কথা শোনা যাচ্ছে, তাকে সাধারণ ভূমিকম্পের থেকে আলাদা করতে ‘মেগাকোয়েক’ বলছেন অনেকে। কিন্তু ফুমিয়াকির মতে, ঝুঁকি থাকতেই পারে। তা নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে, সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন।  সুনামির ক্ষেত্রে উদ্ধারকার্যের সঠিক পরিকল্পনা থাকা দরকার। ২০১১ সালের মার্চ মাসে তোহকু বিপর্যয়ের সময় ২২০টি বাড়ি খালি করে দেওয়া হয়েছিল, শহরের মানুষজনকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই সময় সুনামির উচ্চতা ছিল ৩ মিটার। কিন্তু তাতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আটকানো যায়নি।