নয়াদিল্লি: একনাগাড়ে ভারী বৃষ্টি চলছিলই। মেঘভাঙা বৃষ্টিতে একেবারে ছিন্নভিন্ন অবস্থা। কিন্তু সিকিমের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী আসলে কী, ভারী বর্ষণ নাকি অন্য কিছু? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে অন্য সম্ভাবনা উঠে এল। নেপালের সাম্প্রতিকতম ভূমিকম্পও এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী হতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা সেই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছেন। (Sikkim Flash Flood)


মঙ্গলবার তীব্র কম্পনে কেঁপে ওঠে নেপাল। উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও অনুভূত হয় কম্পন। তার পরই বুধবার সাত-সকালে সিকিমের লোনাক হ্রদের উপর আছড়ে পড়ে মেঘভাঙা বৃষ্টি। তার ধাক্কায় তিস্তা নদীর উপর থাকা চুংথাং বাঁধ ভেঙে পড়ে, যা রাজ্যের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। হড়পা বানে ভেসে যায় একাধিক সেতু, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর। (Sikkim Cloudburst)


হায়দরাবাদের ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্সর থেকে হাতে পাওয়া স্যাটেলাইট-ছবিতে দেখা গিয়েছে, গত ১৭ সেপ্টেম্বর লোনাক হ্রদের দক্ষিণ অংশে যতটা জায়গা চোখে চোখে পড়েছিল, মেঘভাঙা বৃষ্টি আছড়ে পড়ার পর ১০০ হেক্টর জায়গা কমে গিয়েছে। মেঘভাঙা বৃষ্টি আছড়ে পড়ার পর, ভূমির সংকোচন ঘটে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।




স্যাটেলাইট ছবি।


এত বড় বিপর্যয়ের নেপথ্য কারণ খুঁজতে গিয়েই উঠে আসছে সম্প্রতি নেপালে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের প্রসঙ্গ। যে ১৬৮ হেক্টরের লোনাক হ্রদের উপর আছড়ে পড়ে মেঘভাঙা বৃষ্টি, সেটির অবস্থা এমনিতেই তথৈবচ ছিল। সেটির আয়তন বর্তমানে ৬০ হেক্টরে এসে ঠেকেছে। অর্থাৎ জল ডাঙায় উঠে এসেছে।  জলস্তরের সব সীমা পেরিয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের তরফে এমনটাই জানানো হয়েছে সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে।


সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের এক আধিকারিক পিটিআই-কে জানান, মেঘভাঙা বৃষ্টিতে সাধারণত এমনটা ঘটে না। বিশেষজ্ঞদের একটি দল গিয়েছিলেন। এর সঙ্গে নেপালের ভূমিকম্পের যোগ রয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা। আগামী দিনে পরিস্থিতি কোন দিকে বাঁক নেবে, সেই নিয়েও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে বন্যার সতর্কতা জারি হয়েছে। উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকাও বানভাসি হয়ে পড়েছে।


আরও পড়ুন: Sikkim Flood Situation: বেঁচে ফিরলেন নিখোঁজ ১ সৈনিক, এখনও খোঁজ নেই ১০০ জনের, বানভাসি সিকিমে মৃত ১২


যে লোনাক হ্রদের উপর মেঘভাঙা বৃষ্টি আছড়ে পড়ে, সেটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫,২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। লোনাক হিমবাহ গলে গিয়ে এই হ্রদের সৃষ্টি। সিকিমে এমন ৭৩৩টি হ্রদ রয়েছে। এর মধ্যে ২৮৮টি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্সর থেকে হাতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, লোনাক হ্রদের আয়তন এতদিন ১৬২.৭ হেক্টর ছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের দরুণ বরফ গলে তার মধ্যে জলের পরিমাণ লাগাতার বাড়ছিল। ২৮ সেপ্টেম্বর তা বেড়ে ১৬৭.৪ হেক্টর হয়। বর্তমানে তার আয়তন কমে হয়েছে ৬০.৩ হেক্টর।


বিজ্ঞানীদের মতে, হিমবাহ গলে সৃষ্ট হ্রদ যখন হঠাৎ করে স্ফীত আকার ধারণ করে এবং জল উপচে পড়ে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়, তাকে বলা হয় গ্লেশিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড (GLOF)। আচমকা হ্রদের জলের পরিমাণ অত্যধিক হয়ে গেলে অথবা ভূমিকম্পের ফলে এমনটা ঘটে।  এর আগে, ২০১৩ সালে চোরাবাড়ি হ্রদেও এমনটাই ঘটে, যা উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথ বিপর্যয় নামে পরিচিত। ২০১৪ সালে ঝিলম নদীতে ফুঁসে উঠলে কাশ্মীরে ভ.াবহ বন্যা হয়। ২০০৫ সালে হিমাচল প্রদেশের পরেচু নদীতে হড়পা বান দেখা দেয় একই কারণে।


পার্বত্য অঞ্চলেই মূলত এই ঝুঁকি লক্ষ্য করা যায়। ভূমিকম্পের সময় মাটির নীচের পাতগুলির পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। তাতে ধাক্কা খেয়ে হ্রদের পাড়গুলি ভেঙে পড়ে। ফলে জলোচ্ছ্বাস উঠে আসে ডাঙায়। ভূমিকম্পের পর পার্বত্য এলাকায় মাটির নীচে লাভার উদগীরণও ঘটে। তা থেকেও এমনটা ঘটতে পারে। লোনাক হ্রদের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছে, খতিয়ে দেখছেন বিজ্ঞানীরা।