নয়াদিল্লি: মুদ্রাস্ফীতি এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির নিরিখেই এতদিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিচার হতো। কিন্তু গোটা পৃথিবীতে এই মুহূর্তে জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব চোখে পড়ছে, তাতে অর্থনৈতিক সঙ্কটের নয়া পরিভাষা উঠে আসছে। পৃথিবীর সর্বত্র তাপমাত্রা যে হারে বেড়ে চলেছে, তাকে 'তাপস্ফীতি' বলে উল্লেখ করা হচ্ছে, যা পৃথিবীর বুকে খাদ্য সঙ্কট ডেকে আনতে চলেছে বলে মনে করছেন গবেষকরা। (Heatflation Effects)


২০২৪ সালের প্রথম ছ'মাসও এখনও কাটেনি, তার মধ্যেই তাপমাত্রা সর্বকালীন রেকর্ড গড়েছে। ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে, প্রাক শিল্প বিপ্লবের যুগে বৈশ্বিক তাপমাত্রার চেয়ে, বর্তমানে বৈশ্বিক তাপমাত্রায় ১.৫৮ ডিগ্রি বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গিয়েছে। পাশাপাশি, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা একধাক্কায় বেড়ে হয়েছে ২১.০৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অথচ ২০১৬ সালের মার্চ মাসেও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ছিল ২০.৯৫ ডিগ্রি। এতেই প্রমাদ গুনতে শুরু করেছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। (Global Food Security)


বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, তাপমাত্রার লাগাতার এই বৃদ্ধিতে ইতিমধ্যেই আবহাওয়া খামখেয়ালি আচরণ শুরু করেছে। বছরভর বন্যা, খরা লেগে রয়েছে, যাতে কৃষি এবং মৎস্যচাষে গুরুতর প্রভাব পড়ছে। আগামী দিনে এই সমস্যা আরও চরম আকার ধারণ করবে। কারণ তাপস্ফীতির ফলে ইতিমধ্যেই গাছের পরাগ উৎপাদনে পতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগে পরাগরেণুতে যে বৈচিত্র লক্ষ্য করা যেত, তাও আর চোখে পড়ে না। ফলে উদ্ভিদের বংশবিস্তার ব্যাহত হচ্ছে, যা আগামী দিনে খাদ্য সঙ্কট ডেকে আনবে পৃথিবীর বুকে। 


আরলিংটনের ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস, ইউনিভার্সিটি অফ নেভাডা এবং ভার্জিনিয়া টেকের তরফে সম্প্রতি তাপস্ফীতি নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। সিয়েরা নেভাডা পার্বত্য অঞ্চল এবং নদী উপত্যকার গাছপালা নিয়ে গবেষণা চালান বিজ্ঞানীরা। ওই অঞ্চলের মোট ১৯টি এলাকাকে গবেষণার জন্য চিহ্নিত করা হয়। ওই অঞ্চলে ২০০-র বেশি প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে। প্রজাপতির মাধ্যমে পরাগ সংযোগ নিয়ে এর আগে  ২০০০-২০২১  সাল পর্যন্ত গবেষণা হয়। ওই ২১ বছরের রেকর্ডের সঙ্গে বর্তমানে প্রজাপতির মাধ্যমে পরাগ সংযোগের নমুনা পরীক্ষা করে প্রাপ্ত তথ্য মিলিয়ে দেখা হয়, তাতে বিস্তর ফারাক ধরা পড়েছে।


আরও পড়ুন: AI in Medicine: এবার ওষুধও বানাবে AI, দুরারোগ্য ব্যাধির সুরাহা খুঁজবে যন্ত্র


পর্যাপ্ত খাদ্যের জোগান না থাকলে মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে না। তাই ফসল উৎপাদনের জন্য পরাগ সংযোগ এবং পরাগবাহকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক খাদ্যচক্রে যে যে শস্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আগের মতো তার বংশবিস্তার হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে, পরাগ সংযোগে ঘাটতির জেরেই এমনটা ঘটছে, যার নেপথ্য়ে রয়ে জলবায়ু পরিবর্তন। এর হাত থেকে পরাগবাহকদের রক্ষাকরতে সংরক্ষণ নীতি কার্যকর করা অত্যন্ত জরুরি। 


এই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন বেহনাজ বলমাকি। তিনি ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বেহনাজ জানিয়েছেন, উদ্ভিত এবং পরাগবাহকদের মধ্যে যে সম্পর্ক, তাতে প্রভাব ফেলছে জলবায়ু পরিবর্তন। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় একদিকে যেমন ফুল ফোটার সময় বদলেছে, তেমনই পরাগবাহক প্রজাপতি, পাখি এবং অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্বও সঙ্কটে। ফলে যথেষ্ট বংশ বিস্তার হচ্ছে না উদ্ভিদের। ফলনও কমছে, যা থেকে খাদ্য সঙ্কট নেমে আসতে পারে। 


এক্ষেত্রে তাপস্ফীতিকে সরাসরি দায়ী করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে, তীব্র গরম, তাপপ্রবাহের জেরে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই শস্যের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। বাদাম, কোকো, কফি চাষেও এর প্রভাব পড়ছে। ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে ফলন কমে যাচ্ছে, স্বাভাবিক ভাবেই কমে যাচ্ছে খাদ্যের জোগানও। এর ফলে জিনিপত্রের দাম আরও আকাশছোঁয়া হচ্ছে। তীব্র গরমে কমে যাচ্ছে ফসলের পুষ্টিগুণও। এমন চলতে থাকলে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেবে, যেখানে খাবার কেবনার সাধ্যও থাকবে না সাধারণ মানুষের। এর ফলে সমাজে আরও অসাম্য দেখা দেবে, বাড়বে অপুষ্টি এবং ক্ষুধার জ্বালা।


গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রচণ্ড তাপমাত্রায় ধান, গম, ভুট্টা চাষেও সঙ্কট নেমে আসতে পারে আগামী দিনে। ফসল কাটার সময় হওয়ার আগেই গাছ শুকিয়ে যাবে। ফল এবং শাক-সবজির গাছের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রোগ, কীটপতঙ্গ বাসা বাঁধবে গাছে। ফলে স্বাদও কমবে, হ্রাস পাবে পুষ্টিগুণও। শুধু ফসলচাষই নয়, তীব্র গরম থেকে পশুপালও রক্ষা পাবে না বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। মাংস এবং দুগ্ধজাত পণ্যের জোগান হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পেটের জোগান দেওয়ার অবস্থাই যখন থাকবে না, সেখানে আগামী দিনে  স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাও আর মানুষের সাধ্য়ের মতো থাকবে না বলে আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের।