নয়াদিল্লি: বিষধর সাপের ছোবল খেয়ে বেঁচে থাকা আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ খুঁজে পাওয়ারই সমান। কিন্তু একবার নয়, দু’বার নয়, কমপক্ষে ২০০ বার শরীরে সাপের বিষ ধারণ করেও দিব্যি বেঁচে রইলেন এক ব্যক্তি। শুধু বেঁচে থাকাই নয়, সাপের বিষ থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করতে নামভূমিকায় উঠে এলেন তিনি। কারণ তাঁর রক্ত থেকেই এবার সাপের ছোবলের অ্যান্টিভেনম তৈরি হতে চলেছে। শক্তিশালী ওই অ্যান্টিভেনম ১৩ প্রজাতির সাপের বিষকে ঠেকাতে পারবে। (Antivenom for Snakebite)

আমেরিকার নাগরিক Timothy Friede পেশায় ট্রাক মেকানিক। গত ২০ বছর ধরে নিয়মিত নিজের শরীরে সাপের বিষ ধারণ করে আসছেন তিনি। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে কমপক্ষে ২০০ বার নিজের শরীরে সাপের বিষ প্রয়োগ করেছেন তিনি। যে সাপের বিষ সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী, বেছে বেছে এমন প্রজাতির সাপের বিষই নিজের শরীরে ধারণ করেন Timothy. আর তার জেরে এই মুহূর্তে Timothy-এর রক্ত শক্তিশালী অ্যান্টিভেনমে পরিণত হয়েছে। বহু প্রজাতির সাপের বিষ ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে তাঁর রক্ত। তাই তাঁর রক্ত ব্যবহার করেই পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী অ্যান্টিভেনম তৈরি করতে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। (Timothy Friede)

মানুষের জীবন বাজি রেখেই পৃথিবীতে সাপ কামড়ানোর ওষুধ আবিষ্কৃত হয়। হাজার হাজার বছর ধরে এই প্রক্রিয়া চলে আসছিল, যেখানে হাতেগোনা কিছু মানুষের শরীরে বারে বারে অল্প পরিমাণে সাপের বিষ প্রয়োগ করা হতো, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হতো Mithridatism. খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫ থেকে ৬৩ পর্যন্ত তুরস্কে (তদানীন্তন Pontus) ক্ষমতাসীন ছিলেন রাজা ষষ্ঠ Mithridates Eupator. বিষপ্রয়োগ করে মেরে ফেলা হতে পারে আশঙ্কায়, নিয়মিত অল্প করে বিষধারণ করতে শুরু করেন রাজা Mithridates, যাতে কোনও বিষই কাবু করতে না পারে তাঁকে। তাঁর নামেই Mithridatism পদ্ধতির নামকরণ, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাপের বিষের অ্যান্টিভেনম আবিষ্কৃত হয়।

বর্তমানে যদিও Mithridatism-এর প্রচলন নেই। নিরাপদ উপায়ে সাপের বিষের ওষুধ আবিষ্কারের উপায় বের করে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সাপের বিষের ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনী শক্তিশালী ওষুধ তৈরি করতে প্রাচীন পদ্ধতিকেই ভরসা করা হয়। ২ মে Cell জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন আমেরিকার বিজ্ঞানীরা, যেখানে দেশের নাগরিক Timothy-র উপর পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোর কথা জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, গত ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে ২০০-র বেশি সাপের ছোবল খেয়েছেন Timothy. সাপের বিষ সম্বলিত ইঞ্জেকশন নিয়েছেন প্রায় ৭০০ বার। তিল তিল করে নিজের শরীরকে সাপের বিষের প্রতিরোধী হিসেবে গড়ে তুলেছেন। 

Timothy-র রক্তই সাপের বিষের ওষুধ হয়ে উঠেছে, যা থেকে দু’টি অ্যান্টিবডি সংগ্রহ করেন বিজ্ঞানীরা, LNX-D09 এবং SNX-B03. তার সঙ্গে সাপের বিষ প্রতিরোধী varespladib মিশিয়ে তৈরি করা হয় ওষুধ। গবেষণা চালাতে গিয়ে ইঁদুরের শরীরে ওই ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, যা ১৩ প্রজাতির বিষধর সাপের ছোবলকে ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে। শুধু তাই নয়, আরও ছয় প্রজাতির সাপের ছোবলের উপরও আংশিক ভাবে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে ওই ওষুধ. সব ধরনের সাপের ছোবল থেকে না হলেও, সিংহভাগ সাপের বিষের একটি ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা চলছিল বহুদিন ধরেই। Timothy-র হাত ধরে সেই কৃতিত্ব অর্জনের দিকে অনেকটা এগিয়ে গেলেন বিজ্ঞানীরা। কারণ সিংহভাগ বিষধর সাপের ছোবলই ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে ওই ওষুধ. 

বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বর্তমানে পশুদের শরীরে সাপের বিষ প্রয়োগ করেই ওষুধ তৈরি করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন প্রজাতির সাপের ছোবলে বিষের মাত্রায় তারতম্য থাকে। এমনকি একই প্রজাতির সাপের মধ্যেও বিষের মাত্রায় তারতম্য চোখে পড়ে। ভারতে তৈরি ওষুধ সেখানকার সাপের ছোবল ঠেকাতে পারলেও, শ্রীলঙ্কায় ওই একই প্রজাতির সাপের উপর তা কার্যকর হয় না। তাই শক্তিশালী অ্যান্টিবডির প্রয়োজন ছিল, যা প্রায় সব ধরনে বিষধর ছোবল ঠেকাতে পারে। সেই লক্ষ্যেই কাজে হাত দেন বিজ্ঞানীরা। সেই গবেষণার অংশ হতে রাজি হন Timothy. তাঁর রক্তে পৃথিবীর তাবড় প্রাণঘাতী বিষধর সাপের বিষ প্রয়োগ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সবচেয়ে প্রাণঘাতী সাপ হিসেবে যেগুলিকে চিহ্নিত করেছে, তেমন ১৯টি সাপের বিষ প্রয়োগ করা হয় Timothy-র রক্তে, যার মধ্যে ছিল কোরাল, গোখরো, মাম্বা, তাইপান, ক্রেইটস। সেই ১৯টি সাপের মধ্যে ১৩টির বিষ পুরোপুরি ঠেকাতে পেরেছে Timothy-র রক্ত। বাকি ছ’টির উপর আংশিক কার্যকর হয়েছে। কিন্তু যাঁর উপর এই পরীক্ষানিরীক্ষা চলল, তাঁর কি বক্তব্য? BBC-কে Timothy বলেন, “আমার ভালই লাগছে। মানবজাতির জন্য কিছু করছি ভেবেই আনন্দিত আমি। গর্ববোধ হচ্ছে।” দু’বার গোখরোর ছোবল খেয়ে কোমায় চলে যান Timothy. কিন্তু তার পরও পিছিয়ে যাননি তিনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর পৃথিবীতে সাপের ছোবল খেয়ে মারা যান প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ। অঙ্গহানি হয়, শারীরিক ভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন তার চেয়ে তিন গুণ বেশি সংখ্যক মানুষ। সেই অভিশাপ দূর করতে হাসিমুখে দিনের পর দিন যন্ত্রণা সয়ে যান Timothy.