দেহরাদূণ: কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিন নয়, একটানা ১৫ দিন ধরে ভেঙে পড়া সুড়ঙ্গে আটকে ৪১ জন শ্রমিক। বিদেশ থেকে অত্যাধুনিক যন্ত্র এনে, বিশেষজ্ঞের দল ডেকেও এখনও পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি তাঁদের মধ্যে কাউকেই। উত্তরাখণ্ডের ভেঙে পড়া সুড়ঙ্গের ধ্বংসস্তূপ থেকে সকলকে বের করে আনতে বড়দিন এসে যেতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। চেষ্টাচরিত্রে কোনও খামতি রাখা হচ্ছে না বলে যদিও দাবি করছে সরকার। কিন্তু উত্তরাখণ্ডের এই বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত, প্রকৃতির উপর যথেচ্ছ অত্যাচার বন্ধ হওয়া উচিত বলে মত পরিবেশবিদদের। (Uttarakhand Tunnel Collapse)


গত ১২ নভেম্বর ভোররাতে উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলায়, জাতীয় সড়কের উপর নির্মীয়মান সুড়ঙ্গপথের ১৫০ মিটার অংশ ভেঙে পড়ে। সেই থেকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আটকে রয়েছেন ৪১ জন শ্রমিক। তবে এই ঘটনাকে নেহাত দুর্ঘটনা বলে মানতে নারাজ পরিবেশবিদদের একাংশ। কারণ চলতি বছরেই বার বার বিপর্যয় নেমে এসেছে উত্তরাখণ্ডে, কখনও জোশীমঠে মাটির অবনমন, কখনও বানভাসি পরিস্থিতি কখনও আবার ভূমিকম্প, তাতে নয়া সংযোজন সুড়ঙ্গ বিপর্যয়। মনুষ্যনির্মিত সুড়ঙ্গই যদিও ভেঙে পড়েছে, কিন্তু এর নেপথ্যে প্রকৃতির ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। (Uttarakhand Tunnel Crash)


হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের অন্তর্গত লাদাখ থেকে অরুণাচলপ্রদেশ পর্যন্ত হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের অন্তর্গত রাজ্যগুলিকে এমনিতেই পরিবেশগত ভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে ধরা হয়। তাই ওই সমস্ত এলাকায় উন্নয়নের নামে পাহাড় কেটে রাস্তা বা ইতিউতি নির্মাণের বিরুদ্ধে বরাবর সরব পরিবেশবিদরা। তাঁদের মতে, হিমাল পার্বত্য অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল। সামান্য পরিবর্তন ঘটাতে গেলেই বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তার উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিস্থিতিকে আরও ঘোরাল করে তুলেছে।


পরিবেশবিদদের মতে, মেঘভাঙা বৃষ্টি হোক বা হড়পা বান, অথবা ভূমিকম্প, হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে কোনও কিছুই ছোট ঘটনা নয়। শহরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে যাঁরা সেখানে উন্নয়নমূলক প্রকল্প গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা এই বিপদ আঁচ করতে পারেন না, নয়ত বা জেনেশুনেই বিপদ উপেক্ষা করে যান বলে মত পরিবেশবিদদের।


আরও পড়ুন: Uttarakhand Tunnel Rescue: টানেল বিপর্যয়ে এখন ভরসা ভার্টিকাল ড্রিলিং! কীভাবে হবে?


উদাহরণস্বরূপ এক্ষেত্রে চারধাম জাতীয়সড়ক প্রকল্পকে তুলে ধরা হয়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু, যার আওতায় কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, যমুনোত্রী এবং গঙ্গোত্রীর সংযুক্তিকরণ চলছে সড়কপথের মাধ্যমে। আর সেই প্রকল্পের বাস্তবায়ন ঘটাতে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের ৮৮৯ কিলোমিটার জায়গা শনাক্ত করা হয়েছে। এর আওতায় কোথাও পাহাড় কেটে রাস্তা, সুড়ঙ্গপথ, বাইপাস, এমনকি উড়ালপুলও গড়ে তোলা হচ্ছে বলে অভিযোগ। সবমিলিয়ে ১২০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এই প্রকল্পে। কিন্তু উন্নয়ন করতে গিয়ে নিয়ম বহির্ভূত ভাবেই অনেক ক্ষেত্রে এই নির্মাণকার্য চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ। পরিবেশবিদদের দাবি, হয় ওই অঞ্চলের ব্যবহারের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছে সরকার, নয়ত ওই অঞ্চল সংবেদনশীল অঞ্চলের বাইরে বলে মিথ্যে দাবি করা হয়েছে।


সব মিলিয়ে ওই ৮৮৯ কিলোমিটার জায়গায় ৫৩টি প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রকল্পগুলিকে ঘিরে গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ রয়েছে। ২০০২ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশনকে যে সমস্ত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, তার অধিকাংশই পুরাতন বন্য আইনের আওতায় বলে অভিযোগ ওঠে। শুধু তাই নয়, যে জাতীয় সড়কটির নির্মাণ হয়েছে, সেটিও রাজাজি ন্যাশনাল পার্ক, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ন্যাশনাল পার্ক, কেদারনাথ ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি এবং ভাগীরথী পরিবেশ সংবেদনশীল অঞ্চলের মধ্যে পড়ে।    


দুই লেন বিশিষ্ট রাস্তা গড়ে তোলা নিয়ে পরিবহণ সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধার কথা তুলে ধরেছে কেন্দ্র। কিন্তু পরিবেশবিদদের দাবি, যে এলাকা দিয়ে রাস্তা এগিয়েছে, সেখানে অহরহ ধস নামে। গাছপালা সব কেটে সাফ করে দেওয়ায় বিপদ আরও বেড়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে ২০১৯ সালে বিশেষ কমিটি গড়ে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। সব কিছু খতিয়ে দেখে ওই কমিটি যে রিপোর্ট জমা দেয়, তাতে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। কিন্তু তার জন্য রাস্তা তৈরির কাজ আটকায়নি।


পরিবেশবিদদের মতে, এই প্রকল্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত  হয়েছে হিমালয়ের উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগৎ। বনভূমির ৬০০ হেক্টর জমি প্রকল্পের জন্য সাফ করে দেওয়া হয়েছে। তার জন্য ৫৬ হাজারের বেশি গাছ কাটা হয়েছে বলে পরিসংখ্যান সামনে এসেছে। ফলে ছাতার মতো পার্বত্য এলাকাকে যে গাছগুলি আগলে রেখেছিল,  সেগুলির অস্তিত্ব নেই আর। সেই কারণে ইদানীং কালে ধসের ঘটনাও বেড়েছে বলে অভিযোগ।


নির্মাণকার্য চালাতে গিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর উত্তরাখণ্ডে নদীর দূষণও বাড়ছে। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিটির রিপোর্টেই বলা হয়, নদী, ঝর্ণা এবং জঙ্গলে আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। গঙ্গা এবং যমুনা, যার উপর গোটা উত্তর ভারত কার্যত নির্ভরশীল, সেই দুই নদীর জলই দূষিত হয়ে পড়ছে। এর আগে অলকানন্দা এবং ভাগীরথীর ক্ষেত্রে এর পরিণাম দেখা গিয়েছিল। ২০১৪ সালে হড়পা বানের জেরে ৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। নির্মাণকার্য চালাতে যে বিপুর পরিমাণ কাদা-মাটি তোলা হয়, তাও নদীতে গিয়ে পড়ে, নদীর গতিপথ রুদ্ধ করে দেয়।


চারধাম সংযুক্তি প্রকল্প ছাড়াও, ৩৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ চারধাম রেল প্রকল্প গড়ার কাজ শুরু হয়েছে উত্তরাখণ্ডে। তার জন্য ৭৫০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ঘোষণা হয়েছে। ওই রেলপথ এগিয়ে নিয়ে যেতেও জায়গায় জায়গায় সুড়ঙ্গের নির্মাণ শুরু হয়েছে। জোশীমঠের অবনমনের জন্য এই যত্রতত্র সুড়ঙ্গ খোঁড়া এবং পাহাড় কাটাকেই দায়ী করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণকার্যের দিকেও আঙুল উঠেছিল। তাই সুড়ঙ্গ বিপর্যয় কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হলেও, তার সঙ্গেও প্রকৃতি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে।


সিল্কইয়ারা টানেল ধসে পড়ার জন্য নির্মাণকারী সংস্থাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, ওই এলাকায় পাথুরে মাটির গঠন যে দুর্বল, তা পরখ করে দেখেননি ইঞ্জিনিয়াররা। সড়কপথে চারধাম সংযুক্তিকরণের প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ মোটামুটি শেষ। আর ২২৪ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের কাজই বাকি রয়েছে। তার মধ্যেই এই সুড়ঙ্গ বিপর্যয়।