নয়াদিল্লি: অ্যামাজনের রাজধানী হিসেবে গ্রিক পুরাণে উল্লেখ রয়েছে থেমিস্কিরার। সেখানকার নারীরা ছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, যাঁদের রানি ছিলেন হিপোলিটা। পুরুষতন্ত্রের চোখে চোখ রেখে মেয়েদের জন্য নিরাপদ এবং শ্রেষ্ঠ নগরী গড়ে তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু ষড়যন্ত্রের শিকার হন হিপোলিটা। গ্রিক পুরাণের এই আখ্যান পরবর্তী সময়ে সাহিত্যে নানাভাবে জায়গা করে নিয়েছে। নারীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং সমাজে পুরুষতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার কথা বলতে গিয়ে বার বার এই কাহিনির কথা উঠে আসে। কিন্তু হিপোলিটা এবং থেমিস্কিরার কাহিনি কি এবার পাল্টে যাবে? পুরুষতন্ত্রের অবসান ঘটে, আবার কি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা হবে পৃথিবীতে? একটি গবেষণাপত্র ঘিরে নতুন করে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। (Vanishing Y Chromosome)


মানবদেহে মোট ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম রয়েছে, যার মধ্যে ২২ জোড়া অটোজোম এবং এক জোড়া লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজম, মেয়েদের জন্য XX, ছেলেদের জন্য XY. এই Y ক্রোমোজমই লিঙ্গ নির্ধারণ করে। মায়ের পেটে শিশুর পুরুষাঙ্গ তৈরিই হয় এই Y ক্রোমোজম থেকে। কিন্তু এই Y ক্রোমোজমেই জিনের সংখ্যা লাগাতার কমছে। যত সময় যাচ্ছে সঙ্কোচন ঘটছে Y ক্রোমোজমের। এমনিতেই X ক্রোমোজমের থেকে আকারে ছোট Y ক্রোমোজম। জিনের সংখ্যাও অনেক কম, ৫০ থেকে ২০০টি। সেই নিরিখে X ক্রোমোজমের জিনের সংখ্যা ১০০০। তাই যে ভাবে লাগাতার সঙ্কোচন ঘটছে Y ক্রোমোজমের, তাতে উদ্বিগ্ন বিজ্ঞানীরা। একসময় পুরুষের লিঙ্গ নির্ধারণকারী এই Y ক্রোমোজম গায়েব হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের। (Human Genes)


এমনিতেই লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চরিত্র বদল করে চলেছে Y ক্রোমোজম। মেয়েদের XX ক্রোমোজম যেন পরস্পরের সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে জিন উৎপন্ন করতে পারে, ছেলেদের XY-এর ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। বর্তমানে মাত্র ৪৫-৫৫টি জিন রয়েছে Y ক্রোমোজমে।  গত ১৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছরে প্রায় ১৬০০ জিন হারিয়ে ফেলেছে। অর্থাৎ প্রতি ১০ লক্ষ বছরে ১০টি করে জিন হারিয়েছে Y ক্রোমোজম। অর্থাৎ সঙ্কোচনের গতি অত্যন্ত শ্লথ। তাই একেবারে মিলিয়ে যেতে আরও ৪৫ লক্ষ বছর সময় লাগবে। তাহলে কি Y ক্রোমোজমের বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পুরুষও বিলুপ্ত হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে? এই প্রশ্নই ভাবিয়ে তুলেছে বিজ্ঞানীদের। 


গবেষণাপত্রটি পড়ুন


কোনও মহিলা যখন গর্ভবতী হন, ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে Y ক্রোমোজম। গর্ভধারণের ১২ সপ্তাহ পর থেকে মাস্টার জিনটি সক্রিয় হয় এবং ভ্রূণের শরীরে শুক্রাশয় গড়ে ওঠে, যা পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরন তৈরি করে। ফলে ভ্রূণটি ছেলে হিসেবে বাড়তে থাকে। এই মাস্টা জিনটি SRY অর্থাৎ Y ক্রোমোজমের লিঙ্গ এলাকা হিসেবে পরিচিত। ১৯৯০ সালে SRY জিনের আবিষ্কার হয়। মানুষের মতো অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের শরীরেও X এবং Y ক্রোমোজম রয়েছে। তাদের শরীরেও দুই ক্রোমোজমের জিনের সংখ্যায় বিস্তর ফারাক রয়েছে। ফলে Y ক্রোমোজমটির বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই আগামী দিনে পৃথিবী থেকে পুরুষ বিলুপ্ত হয়ে যাবে কি না, শুধুমাত্র নারীই রাজত্ব করবে কি না, উঠছে প্রশ্ন। পুরুষ যদি না থাকে, একা নারী কীভাবে বংশবৃদ্ধি করবে, সেই প্রশ্নও উঠছে।


কেন Y ক্রোমোজম লাগাতার সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে, এখনও পর্যন্ত জবাব খুঁজে পাননি বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, Y ক্রোমোজম সম্পূর্ণ একাকী। কোনও বন্ধু নেই যে তার সঙ্গে জিন লেনদেন করবে। তাই যত সময় যাচ্ছে, তাদের সংখ্যা কমছে। তাই বলে পৃথিবী থেকে পুরুষ একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে, একথা মানতে নারাজ বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে, বর্তমানে Y ক্রোমোজমটি যেভাবে আকার বদলাচ্ছে, তাতে মিলিয়ে যেতে আরও কয়েক লক্ষ বছর সময় লাগবে তাদের। ততদিনে বিকল্প ক্রোমোজম Y তার জায়গা দখল করবে। কারণ মানবশরীর জিনের পরিবর্তে জিন গড়ে তুলতেই অভ্যস্ত।  সম্প্রতি এ নিয়ে আর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়, যাতে জাপানের বিশেষ প্রজাতির ইঁদুরকে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়। ওই পরীক্ষায় দেখা যায়, ইঁদুরের শরীরে Y ক্রোমোজম সম্পূর্ণ ভাবে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তার পরিবর্তে নতুন একটি জিন তৈরি হয়েছে। বিবর্তনের ইতিহাসও বিকল্প ক্রোমোজম তৈরির সাক্ষী। একাধিক এমন প্রাণী রয়েছে, যাদের Y ক্রোমোজম একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে, লিঙ্গ নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি গড়ে উঠেছে শরীরে। মানুষের ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটতে পারে বলে আশাবাদী বিজ্ঞানীরা।