কলকাতা: চাকরি হোক বা ব্যবসা, রোজগারের সঙ্গেই হাত ধরে আসে আর্থিক পরিকল্পনা। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, ভবিষ্যতের সঞ্চয় নানা বিষয় মাথায় রাখতে হয় কোনও আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে। বিনিয়োগের জন্য বহুদিন থেকেই পছন্দের তালিকায় রয়েছে জীবনবিমা। কোনও ব্যক্তির আয় যতই হোক। ভবিষ্যতে কি হবে কেউ জানে না। দুর্ঘটনা হোক বা অসুস্থতা, কোনও কারণে একটি পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ব্যক্তির মৃ্ত্যু হলে অথৈ জলে পড়তে পারে সেই পরিবার। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে সেই পরিবারটিকে। সেই সময় সংসার চালানোর জন্য ন্যূনতম অর্থ জোগাড় করতেও হিমশিম খায় পরিবারটি। এই বিপদ থেকে বাঁচতে অন্যতম ভরসা হতে পারে টার্ম লাইফ ইনস্যুরেন্স। কিন্তু এখন বাজারে এমন অনেক বিমা রয়েছে, যারা এই বিপদে কভারেজ দেয় বলে দাবি করে। ফলে এই সময়ে ঠিক বিমাটি পরিবারের জন্য বেছে নেওয়া বেশ সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন কাজ।


কার জন্য কভারেজ? কতটা কভারেজ?
জীবনবিমা কেনার সময়ে প্রথমেই যে যে প্রশ্নগুলি মাথায় আসে তার মধ্যে অন্যতম হল এই বিমা কেনা কি উচিত হবে? আর যদি কেনা হয় তাহলে কতটা কভারেজ নেওয়া উচিত? আর্থিক বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, কোনও ব্যক্তির উপর বাবা-মা, স্ত্রী বা সন্তানের মতো নির্ভরশীল কেউ থাকলেই বিমা কেনা উচিত। এক্ষেত্রে কারও দেরি করা উচিত নয়, কারণ দেরি হলেই প্রিমিয়ামের অঙ্ক বেড়ে যাবে।
কতটা কভারেজ চাই, তার উত্তরও যথেষ্ট সহজ। কোনও ব্যক্তির আগে দেখা উচিত আর্থিক প্রয়োজন কতটা। কখনও তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর পরিবারের কতটা অর্থ প্রয়োজন সেটাও তাঁকে ভেবে দেখতে হবে। বিমার কভারেজ এমন হওয়া প্রয়োজন, যা ওই ব্যক্তির অবর্তমানে তাঁর আয়ের বিকল্প হতে পারে, কোনও ঋণ থাকলে তাও মিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। আপনার এক বছরের আয়ের প্রায় ২০ গুণ বেশি Sum Assured কভারেজ রাখতে হবে।


যা মাথায় রাখতে হবে:


অনলাইন পদ্ধতি বেছে নেবেন?
অনলাইন নাকি অফলাইন পদ্ধতিতে একটি মেয়াদি বিমা প্ল্যান (টার্ম ইনস্যুরেন্স) কিনছেন, তা আপনার কেনাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করবে। বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট থেকে বিভিন্ন বিমার মধ্যে তুল্যমূল্য বিচার করে অনলাইনে বিমা কেনা সুবিধাজনক এবং সাশ্রয়ী হতে পারে। আপনি বিমার মূল্য এবং অন্য বৈশিষ্ট্যগুলি আলাদা আলাদা করে দেখে বাছাই করতে পারেন। অনলাইনের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীও থাকবেন না। অফলাইনের ক্ষেত্রে এমন বিমা এজেন্ট থাকবেন যাঁরা কোনও পণ্য বিক্রি করার চেষ্টা করবেন। অফলাইন প্ল্যানগুলি খরচসাপেক্ষও হতে পারে কারণ সেগুলি এজেন্টদের মাধ্যমে বিক্রি হয়। সেক্ষেত্রে তাঁরা নিজেদের সুবিধামতো প্ল্যান বিক্রি করার চেষ্টা করেন।


কতদিনের বিমা হবে?
সাধারণত কোনও ব্যক্তি যে বয়সে অবসর নিতে চান তার উপর নির্ভর করে বিমা পলিসির মেয়াদ স্থির করা উচিত। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এক ব্যক্তি যে বয়সে অবসর নিতে চান এবং এখন তাঁর যে বয়স তার মধ্যেকার পার্থক্যই বিমার মেয়াদ হওয়া উচিত। এছাড়াও, যাঁদের উপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীলতা রয়েছে তাদের জন্য বিমা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস। যখন বয়স কম থাকবে তখন বিমার প্রিমিয়ামও কম হবে। ফলে অল্প বয়সেই মেয়াদি বিমা বা টার্ম ইনস্যুরেন্স কেনা প্রয়োজন। এছাড়া, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিমার দিকেও খেয়াল রাখা উচিত। যেমন, যখন কোনও ব্যক্তি একা রয়েছেন তখন তাঁর যা বিমা রয়েছে, তিনি বিয়ে করার পর সেই বিমারাশি পর্যাপ্ত হবে না। ফলে সময় বুঝে, পরিবারকে নিরাপদ রাখার জন্য বিমার কভারেজের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিভিন্ন ধরনের বিমা রয়েছে, সেগুলির মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস এখানে বলা হল।


মেয়াদি বিমা (টার্ম ইনস্যুরেন্স):
আপনার অসময়ে মৃত্যু হলে, আপনার পরিবারকে আর্থিকভাবে রক্ষা করার জন্য মেয়াদি বিমাকে সবচেয়ে ভাল বলা হয়ে থাকে। এটি বাজারে উপলব্ধ জীবন বিমাগুলির মধ্যে সহজতম। এই পদ্ধতিতে কোনও ব্যক্তি কোনও বিমা সংস্থাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অল্প কিছু প্রিমিয়াম দিয়ে খুব বেশি পরিমাণের কভারেজ পেতে পারেন। এইচডিএফসি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মেয়াদি বীমা পলিসি ক্লিক টু প্রোটেক্ট লাইফ এমনই একটি পলিসি। এটি একটি স্বতন্ত্র মেয়াদি বিমা যা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বদলে যাওয়া চাহিদার কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় মৃত্যু এবং গুরুতর অসুস্থতা দুটি ক্ষেত্রই কভার করা হয়েছে। এই প্ল্যানে ৩টি অপশন রয়েছে। জীবন ও গুরুতর অসুস্থতা অটো-ব্যালেন্স, লাইফ প্রোটেক্ট অপশন এবং ইনকাম প্লাস অপশন৷ প্রতিটিই নিজের নিজের ক্ষেত্রে আলাদা। যেমন ইনকাম প্লাস অপশনটি নিয়মিত আয়ের জন্য ব্যবহার করা যায়। এই প্ল্যানের ক্ষেত্রে বিমাকৃত ব্যক্তির ৬০ বছর হয়ে গেলে তাঁদের জন্য নিয়মিত আয়ের সুবিধা থাকে। অনলাইনেই এই প্ল্যান কেনা যায়। এই বিমা প্ল্যান থাকলে ওই ব্যক্তির কোনও কারণে মৃত্যু হলে যিনি নমিনি রয়েছেন তিনি বড়সড় অঙ্কের অর্থ পাবেন।


ইউনিট লিঙ্কড ইনস্যুরেন্স প্ল্যান:
একটি ইউনিট-লিঙ্কড বিমা প্ল্যান হল বিমার সঙ্গে বিনিয়োগের মেলবন্ধন। এটি এমন একটি বিমা প্ল্যান যা কোনও ব্যক্তিকে জীবন বিমার সুবিধা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্পদ তৈরির কাজেও সাহায্য করে। এক্ষেত্রে প্রিমিয়ামের দুটি ভাগ করা হয়। একটি জীবনবিমার জন্য যায় অন্যটি সম্পদ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এই প্ল্যানের ক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তি সম্পদ তৈরির খাতে যে টাকা দিয়েছিলেন তা তুলেও নিতে পারেন।


হোল লাইফ ইনস্যুরেন্স পলিসি:
জীবনবিমার কিছু প্ল্যানের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের পরে বিমার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, কিন্তু হোল লাইফ ইনস্যুরেন্স পলিসির ক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তি যতদিন বেঁচে থাকবেন (১০০ বছর বয়স পর্যন্ত) ততদিন বিমার সুবিধা পাবেন। এই প্ল্যানের ক্ষেত্রে যাঁর নামে বিমা তিনি অর্থের একটি অংশ তুলতে পারবেন অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ধার করতে পারবেন।


চাইল্ড ইন্স্যুরেন্স প্ল্যান:
শিশুদের জন্যও বিমা পরিকল্পনা রয়েছে। এই ধরনের প্ল্যান বিমা ও বিনিয়োগ দুটির সুবিধাই দিয়ে থাকে। আপনার সন্তানের আর্থিক প্রয়োজনও মেটাতে পারে এই বিমা। এই ধরনের বিমার মাধ্যমে আপনি আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য একটি বড়সড় তহবিল তৈরি করতে পারবেন।


অ্যানুইটি/অবসর প্ল্যান:
এটি এমন একটি বিমার প্ল্যান যা আর্থিক স্থিতাবস্থা প্রদান করে এবং অবসরকালের জন্য সম্পদও তৈরি করতে সাহায্য করে। অ্যানুইটি অনেকটা পেনশনের মতো। যা নিয়মিত আয়ের সুবিধা দেয়, অবশ্য সেই কারণে এককালীন অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়।


জীবন বিমা কোনও ব্যক্তি বিনিয়োগ পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফলে ভেবেচিন্তে সবদিক দেখে উপযুক্ত পরিকল্পনা বেছে নেওয়া প্রয়োজন। বিমা কেনার ক্ষেত্রে অবশ্যই নজর রাখবেন সংস্থার দিকেও। যে বিমা সংস্থার ক্লেম সেটেলমেন্ট রেকর্ড ভাল, উপভোক্তাদের তরফে ভাল রিপোর্ট রয়েছে সেই বিমা সংস্থা থেকেই বিমা কেনার কথা ভাবুন। জীবনবিমা কেনার আগে ভাল করে ভাবনা-চিন্তা ও গবেষণা করা প্রয়োজন কারণ জীবনে ক্ষতি এড়ানো যায় না। কিন্তু জীবনে সেই ক্ষতি কতটা প্রভাব ফেলবে তা পাল্টানো যেতে পারে।