কলকাতা: ময়দানের খুব চেনা ছবি। সিএবি (CAB) আয়োজিত ম্যাচ চলছে। আর মাঠের ধারে টেবিল পেতে বসে রয়েছেন অফিশিয়াল স্কোরার। পরনে সিএবির লোগো লাগানো টি-শার্ট। টুপি। তীব্র দাবদাহের মধ্যেও প্রত্যেক বলের আপডেট লিখে চলেছেন স্কোরশিটে। ম্যাচ শেষ হতেই স্কোরশিট বগলদাবা করে ইডেন গার্ডেন্স (Eden Gardens) অভিমুখে দৌড়। সিএবি-তে তা জমা দিয়ে তারপর ছুটি।


ক্রিকেট থেকে টোটো


চল্লিশ পেরনো তারক দে-র (Tarak De) রোজনামচা অবশ্য বেশ অন্য়রকম। ম্যাচ শেষ মানে যাঁর দিনের প্রথম ইনিংসের সমাপ্তি। শিয়ালদা থেকে বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরে পরের ইনিংসের প্রস্তুতি। নৈহাটির বাড়িতে ফিরেই তিনি বেরিয়ে পড়বেন টোটো নিয়ে। শুরু হবে নতুন এক লড়াই।


তারক সিএবি-র ম্য়াচে স্কোরিং করেন। দিনের বাকি সময়টা টোটোও চালান। বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানের সংসারে তিনি যে একমাত্র রোজগেরে। তাই একটু জিরিয়ে নেওয়ার ফুরসতও নেই।


তালতলা মাঠে গিয়ে যখন তারকের দেখা পাওয়া গেল, তিনি ডুবে রয়েছেন ম্য়াচে। তবে দিনটি তারকের কাছে বেশ স্বস্তির। সকালে একটি ম্যাচ করিয়েছেন। দুপুরে আরেকটি। ম্যাচ প্রতি ৯৫০ টাকা পান। একদিনে জোড়া ম্যাচ করে ১৯০০ টাকা প্রাপ্তি। তারকের চোখেমুখে যেন খুশির ছোঁওয়া।


'ময়দানে ম্যাচ থাকলে রাত তিনটেয় উঠি। সাড়ে তিনটে থেকে পাঁচটা পর্যন্ত টোটো চালাই। তারপর গড়িফা থেকে ৫.৪৩ এর ট্রেন ধরে শিয়ালদা। ময়দানে পৌঁছে যাই ম্যাচ শুরু হওয়ার অনেক আগেই,' বলছিলেন তারক।


খেলা ছেড়ে ম্যাচ পরিচালনা


স্কোরিংয়ে আসা কীভাবে? তারক বলছেন, 'ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছে ছিল। মাধ্যমিকের পর ১৯৯৭ সালে গড়িফা ইউনাইটেড স্পোর্টিং ক্লাবে খেলা শুরু করি। বাবার দুধের ব্যবসা ছিল। সামান্য রোজগার। ইচ্ছে থাকলেও খেলা আগে শুরু করতে পারিনি। নৈহাটির স্টেডিয়াম মাঠে প্রয়াত কোচ অরুণ সেনগুপ্তর প্রশিক্ষণে খেলতাম।' যোগ করলেন, '১৯৯৯ সালে আম্পায়ারিং শুরু করি। জেলা থেকে আম্পায়ারিংয়ের কোর্স করেছিলাম। ম্য়াচ প্রতি পেতাম ৩০ টাকা। এক মরসুমে ৫২টি ম্যাচ খেলিয়েছিলাম। তারপরই সিএবি-র প্রয়াত স্কোরার কৌশিস সাহা বলেন, স্কোরিং শুরু করছিস না কেন? সেই থেকে স্কোরিং করতে শুরু করি। সুবার্বান ক্লাবের হয়ে স্কোরিং করতাম।'


রায়না-আরপিদের স্কোরিং


প্রায় ২৩ বছরের স্কোরিং জীবনে সেরা মুহূর্ত হয়ে রয়েছে ২০০০ সালের একটি ম্যাচ। তারক বলছেন, 'সেবার হাওড়া ইউনিয়নের হয়ে খেলতে এসেছিলেন সুরেশ রায়না, রুদ্রপ্রতাপ সিংহ। ওঁদের ম্যাচ খেলিয়েছিলাম।'


ইডেনে অনূর্ধ্ব ১৩ বিভাগের ম্যাচে স্কোরিং করেছেন। রয়েছে তিক্ত স্মৃতিও। সাল ২০০৩। ইডেনে ম্যাচে স্কোরিং করার সময় প্রবল গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন ৯ জন। তারকও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। আপদকালীন চিকিৎসায় কোনওমতে যেন রক্ষা পান।


দুই কামরায় স্বপ্ন


নৈহাটিতে দুই কামরার বাড়ি। একটি ঘর ঢালাই করা। অন্যটি টালির চালের। বড় ছেলে মাধ্যমিক দিয়েছে। ছোট ছেলে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। তারক বলছেন, '২০০৪ সাল পর্যন্ত স্কোরার হিসাবে কাজ করি। তারপর অভাবের তাড়নায় একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ শুরু করি। ১২০০ টাকা মাইনে পেতাম। কয়েক বছর পর ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের আম্পায়ার সুশান্ত পাঠক খবর দেন যে, সিএবি-তে স্কোরারদের পরীক্ষা হচ্ছে। সেই পরীক্ষায় বসি। পাশও করি। ফের স্কোরিংয়ে ফেরা।'


কিন্তু শুধু স্কোরার হিসাবে কাজ করে সংসার চালানো দায়। ২০১৯ সালে ৪০ হাজার টাকা জমা রেখে টোটো কেনেন। ম্যাচ থাকলে ভোররাতে ও সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে টোটো চালান। অন্যসময় সারাদিন ধরেই চলে টোটো। অতিমারির সময় করোনা রোগীদের নিয়ে দিনরাত ছুটে গিয়েছেন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে। তারক বলছেন, 'করোনা রোগীদের পাশে সাধ্যমতো থেকেছি। নিজে দুবার করোনা আক্রান্ত হয়েছি। বহু করোনা রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। অনেকে পছন্দ করেননি। পাড়ায় সকলে এড়িয়ে চলতেন। পরে অবশ্য সকলে ভুল বুঝতে পারেন।'


ক্রিকেট মাঠে অদ্ভুত এক শান্তি পান তারক। প্রত্যেক বলে বাউন্ডারি, ওভার বাউন্ডারি, ওয়াইড, নো, বাই রানের হিসেব রেখেই যেন অভাবের জ্বালা আর জীবনযুদ্ধের ধকল ভুলে থাকতে পারেন।


আরও পড়ুন: লখনউকে ১৮ রানে হারিয়ে পয়েন্ট তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আরসিবি