সন্দীপ সরকার, কলকাতা: রাতারাতি বদলে গিয়েছে তাঁর জগৎ। একটা সময় ইডেন গার্ডেন্সে (Eden Gardens), সল্ট লেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে তিনি প্র্যাক্টিস করতে গেলে কোচ ও সতীর্থরা ছাড়া আর কেউই খবর রাখতেন না। এখন তাঁকে ঘিরে ধরছেন সইশিকারিরা। সেলফি তোলার আব্দার সামলাতে হচ্ছে। (BCCI) বাড়ির সামনে সংবাদমাধ্যমের ভিড়। আর প্রায় সকলের মুখে একটাই অনুরোধ, 'সোনার পদকটা একবার দেখা যাবে?'


এই কদিনে জীবন কতটা পাল্টাল? হাওড়ার বালিটিকুরিতে নিজের বাড়িতে দাঁড়িয়ে ভারতের অনূর্ধ্ব ১৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী (Womens T20 World Cup) দলের সদস্য হৃষিতা বসু (Hrishita Basu) বলছিলেন, 'সত্যিই জগৎ অনেকটা পাল্টে গিয়েছে। বসার ফুরসত পাচ্ছি না। সবাই বাড়িতে আসছেন অভিনন্দন জানাতে। বলছেন, তোমরা দেশকে গর্বিত করেছো। ভাল লাগছে। সব কিছুই তো সমর্থকদের জন্য করা।'


বাড়ির ছাদ থেকে, জানালা থেকে ঝুলছে জাতীয় পতাকা। গোটা পাড়া মুড়ে ফেলা হয়েছে তেরঙা বেলুনে। সবুজ ও লাল কার্পেট বেছানো বাড়ির রাস্তায়। হৃষিতা বলছেন, 'দক্ষিণ আফ্রিকা পৌঁছেই মনে হয়েছিল, আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েই ফিরব। কিন্তু ফাইনাল জেতার পর বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম, স্বপ্ন দেখছি, নাকি সত্যিই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছি!'


মহিলাদের অনূর্ধ্ব ১৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড। যাদের বিরুদ্ধে মহিলাদের ক্রিকেটে ভারতের সাম্প্রতিক রেকর্ড ভাল নয়। সিনিয়র বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংরেজদের কাছে হারতেও হয়েছিল। ফাইনালে ফের সামনে ইংল্যান্ড। স্নায়ুর চাপ টের পাচ্ছিলেন? হৃষিতা বলছেন, 'আমরা খোলা মনেই খেলতে নেমেছিলাম। ভাল খেলায় জোর দিয়েছিলাম। প্রতিপক্ষ কারা, সেটা নিয়ে ভাবিনি।'


ভারত-ইংল্যান্ড ফাইনাল দেখতে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন অলিম্পিক্সে সোনাজয়ী নীরজ চোপড়া। ফাইনালের আগে ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা কেমন? 'আমাদের দলের তরফে নীরজ চোপড়াকে ট্র্যাভেল পুলওভার দেওয়া হয়েছিল। সেটা পরে উনি আমাদের সঙ্গে ছবি তোলেন। ভীষণ অমায়িক। ওঁর কথায় ভীষণ উৎসাহিত হয়েছিলাম,' বলছিলেন বিশ্বকাপজয়ী কন্যা।


হৃষিতার ক্রিকেটে আসা খানিকটা কাকতালীয়ভাবে। বাড়ির সকলে খেলাধুলো ভালবাসেন। মায়ের সঙ্গে ইংরেজির কোচিং ক্লাসে গিয়েছিলেন হৃষিতা। তাঁর কথায়, 'আমি আধ ঘণ্টা আগে পৌঁছে যাই। ইংরেজির ম্যাম বলেছিলেন, একটু অপেক্ষা করো। তখন মা আমাকে নিয়ে যায় ডুমুরজলা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে। আমি খেলাধুলো ভালবাসতাম। স্কুলের দলে সব ধরনের খেলায় অংশ নিতাম। খো খো, থ্রো বল, বাস্কেটবল - সব খেলেছি। ডুমুরজলা কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখি, ক্রিকেট খেলা চলছে। সেই ভাল লেগে যাওয়া। তারপর হাওড়া স্পোর্টিং ক্লাবে ভর্তি হই। প্রথম প্রথম অস্বস্তি হতো। সপ্তাহ দুয়েক পরেই অবশ্য খেলাটাকে ভালবেসে ফেলি।'


বাংলার অনূর্ধ্ব ১৬ দলে ট্রায়াল দিয়েছিলেন। কিন্তু সুযোগ পাননি হৃষিতা। তবে বাংলার অনূর্ধ্ব ১৯ দলে সুযোগ পান। গোয়ার বিরুদ্ধে অভিষেক হয়। চ্যালেঞ্জার্স ট্রফিতেও খেলেন। তারপর সিএবি-র টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে নজর কাড়েন উইকেটকিপার-ব্যাটার। জোনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমি ও জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে জায়গা করে নেন। বিশ্বকাপের জাতীয় দলে সুযোপ পাবেন অবশ্য ভাবেননি হৃষিতা।


হতে চেয়েছিলেন মিডিয়াম পেসার। হয়ে গেলেন উইকেটকিপার। কীভাবে? 'আমার উচ্চতা কম থাকায় স্যার-ম্যামরা পরামর্শ দেন, উইকেটকিপিং করতে। সেই থেকে কিপিং শুরু করি,' বলছিলেন হাওড়ার মেয়ে। বিশ্বকাপের দলে ছিলেন বাংলারই রিচা ঘোষ। তিনিই উইকেটকিপার-ব্যাটার। তবে হৃষিতা বলছেন, 'রিচা সিনিয়র দলেও খেলেছে। ওর সঙ্গে আমার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। ও দলে থাকলে বরং লাভ হবে। কারণ ও বিগহিটারও। আমি ব্যাটিংয়ে জোর দিয়েছিলাম। যাতে প্রথম একাদশে সুযোগ পাই।'


মুম্বইয়ে রমাকান্ত আচরেকর ছোট্ট এক বালককে স্কুটারের পিছনে চাপিয়ে মাঠে মাঠে টুর্নামেন্ট খেলাতে নিয়ে যেতেন। পরবর্তীকালে সেই বালককে ক্রিকেট বিশ্ব চিনেছিল সচিন তেন্ডুলকর নামে। হৃষিতাও মায়ের স্কুটির পেছনে বসে দূর দূরান্তের মাঠে গিয়েছেন ম্যাচ খেলতে, প্র্যাক্টিস করতে। হাওড়ার সদ্য উনিশ পেরনো মেয়ে বলছেন, 'অনেক সময় মায়ের শরীর খারাপ থাকত। কোমরে ব্যথা হতো। তবু কখনও হাল ছাড়েনি। স্কুটি চালিয়ে দু-আড়াই ঘণ্টার দূরের মাঠে নিয়ে গিয়েছে। আমি পিছনে বসে গুগল ম্যাপে রাস্তা বলে দিতাম। মায়ের এই ত্যাগ ভোলার নয়।'


দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফেরার পর আমদাবাদে কিংবদন্তি সচিনই প্রথম সংবর্ধনা জানান বিশ্বকাপজয়ী দলকে। হৃষিতা বলছেন, 'আমরা ভীষণ দুষ্টু। কিন্তু সচিন স্যার কথা বলার সময় সবাই মন দিয়ে শুনছিলাম। আমাদের সঙ্গে করমর্দন করেন। খুব উৎসাহ দেন। ভারত-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ দেখি সচিন স্যারের পাশে বসে।'


সম্পূর্ণ ভিডিও সাক্ষাৎকার দেখুন এই লিঙ্কে ক্লিক করে: 


মহিলা ক্রিকেটারদের মধ্যে ঝুলন গোস্বামী ও মিতালি রাজ তাঁর আদর্শ। পুরুষ ক্রিকেটে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। ক্রিকেট অন্ত প্রাণ। অবসর সময়ে কী করেন? হৃষিতা হাসতে হাসতে বলছেন, 'পাড়া ক্রিকেট খেলি।'


অনূর্ধ্ব ১৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে নতুন লক্ষ্য সাজিয়ে ফেলেছেন হাওড়ার মেয়ে। হৃষিতা বলছেন, 'মার্চ মাসে মহিলাদের আইপিএল (WIPL)। ১১ ফেব্রুয়ারি নিলাম রয়েছে। মহিলাদের আইপিএলে খেলতে মুখিয়ে রয়েছি। আশা করছি কোনও দল কিনবে। পাশাপাশি এবার সিনিয়র দলেও সুযোগ পেতে চাই। আমাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে।'


আরও পড়ুন: ABP Exclusive: ১০৬৭-র জবাবে প্রতিপক্ষ অল আউট মাত্র ৪ রানে! মেয়র্স কাপে বিরল রেকর্ড