সন্দীপ সরকার, কলকাতা: নোটিশ জারি হয়ে গিয়েছে। ৩১ অক্টোবর সিএবি-র (CAB) নির্বাচন। বঙ্গ ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থার দায়িত্বভার আগামী ৩ বছর কাদের হাতে থাকবে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানা যাবে সেদিন।
আনুষ্ঠানিকভাবে কথাটা লিখতে হচ্ছে, কারণ, সিএবি-র ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে বার্ষিক সাধারণ সভার ১৭ দিন আগেই। ১৪ অক্টোবর। শুক্রবার। কারণ, সেদিন চূড়ান্ত বৈঠকে বসছে সিএবি-র বিরোধী শিবির। যে শিবিরের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক, রাজ্যের শাসক দলের দুই সর্বেসর্বা!
চমকে উঠলেও বিশ্বস্ত সূত্র মারফত এরকমই জানা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের দুই প্রধান মুখ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Benrjee) ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee)। এবং সিএবি-র মসনদের ভবিষ্যৎ ফের নির্ধারিত হতে পারে নবান্নের নির্দেশে।
প্রথমে মনে করা হচ্ছিল, আসন্ন সিএবি-র নির্বাচনে শাসক ও বিরোধী, দুই গোষ্ঠীর ধুন্ধুমার লড়াই হবে। নির্বাচনী দামামা বেজে যেতেই আসরে নেমে পড়েছিল শাসক ও বিরোধী, যুযুধান দুই গোষ্ঠীই। এমনিতে বঙ্গ ক্রিকেটের সাম্প্রতিক ইতিহাস বলছে, নির্বাচন মানে ইলেকশন নয়, বরং সিলেকশন। হয় প্রথা ভেঙে নবান্ন থেকে ঘোষণা করা হবে কারা সিএবি-র মসনদে থাকবেন। অথবা সর্বসম্মতভাবে কোনও পদে কে থাকবেন, বেছে নেওয়া হবে।
যদিও এবার সেই ছবি পাল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠেছিল। সিএবির বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) জন্য বিরোধী পক্ষ প্যানেল সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। শোনা যাচ্ছিল, অন্তত চারটি পদে প্রার্থী দিতে পারে বিরোধী শিবির। যে শিবিরের অন্যতম মুখ সিএবি-র তিন প্রাক্তন কর্তা - গৌতম দাশগুপ্ত, বিশ্বরূপ দে ও সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়। এদের মধ্যে বিশ্বরূপ এখন রাজ্যের শাসক দলের প্রতিনিধি। কাউন্সিলরও। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের শীর্ষকর্তা দেবব্রত সরকার ও বিশ্ব মজুমদার। ইতিমধ্যেই তাঁরা বেশ কয়েকবার নিজেদের মধ্যে বৈঠক সেরে নিয়েছেন বলেই খবর। যে বৈঠকের প্রাথমিক নির্যাস ছিল, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বা অভিষেক ডালমিয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে কোনওরকম আপোসে যাওয়া হবে না। স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে লড়া হবে। তারপর ভোটের নিরিখে দেখা যাবে, কারা থাকবে সিএবি-র মসনদে।
কিন্তু সেই মারমার কাটকাট মানসিকতা বেশ কিছুটা বদলে গিয়েছে মঙ্গলবারের পর থেকে। যেদিন আরব সাগরের তীরে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে যে, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly) আর ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের মসনদে থাকছেন না। রাজ্যের শাসক দলের বিভিন্ন প্রতিনিধি তারপর থেকেই বিবৃতি দিতে শুরু করেন যে, বিজেপির হয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতি না করার খেসারত দিতে হয়েছে সৌরভকে। বিজেপিকে কাঠগড়ায় তোলাও শুরু হয় তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে। কুণাল ঘোষের মতো শাসক দলের অন্যতম প্রধান মুখেরা বলতে থাকেন, বোর্ডের পদাধিকারী হিসাবে যেখানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুত্র বা কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রীর ভাই রয়েছেন, নতুন করে যেখানে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি ঘনিষ্ঠ বা নেতাদের, সেখানে শুধুমাত্র রাজনীতিতে না জড়ানোয় ব্রাত্য হয়ে যেতে হল সৌরভকে।
এরপর থেকেই সমীকরণ কিছুটা হলেও বদলাতে শুরু করেছে বলে খবর। সৌরভের দিকে সহানুভূতির হাওয়া বইতে শুরু করেছে। শোনা যাচ্ছে, সৌরভ নিজেও শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। সম্প্রতি ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকার যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, সেখানেও মধ্যমণি ছিলেন সৌরভ। মমতা-সৌরভকে মঞ্চে পাশাপাশি দেখা গিয়েছিল।
এমনিতে সিএবি প্রশাসনে সৌরভ সরাসরি প্রবেশ করবেন বলে খবর নেই। কারণ, ২০১৪ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত টানা ৫ বছর ৩ মাস রাজ্য ক্রিকেট সংস্থায় পদাধিকারী ছিলেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সংশোধিত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, টানা ৬ বছর প্রেসিডেন্ট ও সচিব, এই দুই শীর্ষপদে থাকা যায়। সেদিক থেকে সৌরভের হাতে আর ৯ মাস পড়ে রয়েছে এবং একটা সম্পূর্ণ মেয়াদকাল তিনি সিএবি প্রশাসনে থাকতে পারবেন না। যদি না ছক ভেঙে, আসন্ন ওয়ান ডে বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখে, আগামী বছর নির্দিষ্ট সময়ের আগে নির্বাচন করা হয়।
তবে বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, সৌরভের পছন্দের প্রার্থী হিসাবে সিএবি প্রশাসনে দেখা যেতে পারে কয়েকজনকে। প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, সচিব, যুগ্মসচিব ও কোষাধ্যক্ষ - এই পাঁচ পদ নিয়ে সকলের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রধান দাবিদার সৌরভের দাদা স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। বাকি সবকটি পদ নিয়েই ধোঁয়াশা রয়েছে। সিএবি-র শাসক গোষ্ঠী চায় নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের দায়িত্বে রাখতে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট অভিষেক ডালমিয়ার মেয়াদ শেষ। তাঁকে রাজ্য সংস্থা থেকে তিন বছরের বাধ্যতামূলক কুলিং অফে যেতে হবে। যুগ্মসচিব, সৌরভ শিবিরের অন্যতম কর্তা দেবব্রত দাসকে নিয়ে বিরোধীদের তীব্র আপত্তি রয়েছে। প্রশ্ন রয়েছে কোষাধ্যক্ষ দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়েও। সৌরভ শিবির থেকে আবার ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রাক্তন ক্রিকেটার সঞ্জয় দাস, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়দের নাম।
বিরোধী গোষ্ঠী চায় নিজেদের প্রার্থীদের দায়িত্বে আনতে। বিশ্ব মজুমদার, সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়দের পাশাপাশি শোনা যাচ্ছে একাধিক রাজনৈতিক হেভিওয়েটদের নাম। বলা হচ্ছে, নবান্ন সবুজ সংকেত দিলে দায়িত্বে আসতে পারেন শাসক দলের কোনও হেভিওয়েট নেতা।
দুই পক্ষের মধ্যে সম্মানজনক সমঝোতার উদ্যোগও চলছে। ৮ সেপ্টেম্বর ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকারের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন সৌরভ। বিরোধী শিবিরও একাধিক বৈঠক করেছে।
তবে শেষ হিসাবে সব কিছু নির্ভর করে রয়েছে নবান্নের ইঙ্গিতের ওপর। শোনা যাচ্ছে, তৃণমূল কংগ্রেসের হাইকম্যান্ডের ওপর পুরো সমীকরণটাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান দুই মুখ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী শিবিরের সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। খোঁজখবর নিচ্ছেন।
এবং সব কিছু ঠিকঠাক চললে, নির্বাচন না-ও হতে পারে। বরং দুই পক্ষের প্রার্থীই সুযোগ পেতে পারেন পদাধিকারী হিসাবে। সব কিছুই আপাতত মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষ।
যে সিলমোহর পড়ে যেতে পারে ১৪ অক্টোবর সন্ধ্য়ার বৈঠকে।
আরও পড়ুন: বোর্ডে সৌরভের ব্রাত্য হওয়ার মঞ্চেই আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলে ঢোকার পথে অভিষেক