নয়াদিল্লি: ভারতীয় দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলির ব্যাট হাতে সোনালি সাফল্যের দৌড় অব্যাহত। এই ব্যাটিং দাপটের জেরেই ভারতের প্রাক্তন ব্যাটসম্যান সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে তাঁর তুলনা শুরু হয়েছে। সচিন, না কোহলি-কে সেরা? তর্কে তুফান উঠছে চায়ের টেবিলে। চুলচেরা বিশ্লেষণে যে যার প্রিয় তারকাকে সেরার আসনেই বসাতে চান। আর তা নিয়ে কত বন্ধুত্বই না ভেঙে গিয়েছে! সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকায় একদিন ও টি ২০ সিরিজ জিতেছেন ভারত। এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় দল কোনও সিরিজই জিততে পারেনি। আসলে ওই সফরে দুটি দলের মধ্যে একমাত্র ফারাকটি ছিলেন কোহলি। তাঁর কয়েকটি ম্যাচ জেতানো ইনিংসের দৌলতেই ভারত সিরিজ পকেটে পুরতে পেরেছে। এই সিরিজ কোনও ব্যতিক্রম নয়। ভারতীয় দলকে এ ধরনের সাফল্য বারেবারেই এনে দিয়েছেন কোহলি। বর্তমানে ভারতীয় দলে যে ভূমিকাটা পালন করছেন কোহলি, কয়েক বছর আগে তার ভার ছিল সচিনের কাঁধে। ভারতীয় দলের ব্যাটিং স্তম্ভ ছিলেন সচিন। তখন ভারতীয় সমর্থকদের কাছে ক্রিকেট দেখা মানে ছিল সচিনের ব্যাটিং দেখা, তাঁর একটা সেঞ্চুরি সমর্থকদের খুশিতে ভরিয়ে দিত। অনেকেই বলেন, সচিন যেভাবে অন্যদের অনুপ্রাণিত করতে, আবেগ উস্কে দিতেন, তা সেভাবে কোহলি পারেন না।এই মতের বিরুদ্ধে যাঁরা, তাঁরা সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা প্রশ্ন তুলে দেন, ভারতকে সচিন কটা ম্যাচ জিতিয়েছেন? একদিনের ক্রিকেটে তাঁদের বেশিরভাগ সেঞ্চুরি এসেছে, এমন সব ম্যাচে, যেগুলিতে ভারত জিততে পারেনি। সচিন ও কোহলি প্রেমীদের মধ্যে এই তর্কের মধ্যেও একটা বিষয়ে কিন্তু সবাই একমত। দুজনেই ক্রিকেটপ্রেমীদের আকৃষ্ট করেন, তাঁদের খেলতে দেখলে সারা দেশ এক হয়ে যায়। সচিন যখন খেলতেন, তখন রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত। আর কোহলি খেললে মুঠোফোন নামিয়ে রাখেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। আসলে দুজনে দুটি প্রজন্মের ব্যাটসম্যান। তাই দুজনের মধ্যে তুলনা করাটা খুবই কঠিন। পিচ ও বাউন্ডারি লাইন:গত কয়েক বছরে ক্রিকেট অনেকটাই বদলে গিয়েছে। এখন ক্রিকেট ব্যাটসম্যানদেরই দাপট। যে পরিবর্তন এসেছে, তা ব্যাটসম্যানদের পক্ষেই অনুকূল। সেইসঙ্গে বাণিজ্যিক দিকটিরও রমরমা প্রচুর বেড়ে গিয়েছে। বিজ্ঞাপনদাতারা চান, প্রচুর চার-ছয় হোক। এতে ওই ব্যাটসম্যানদের ব্র্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করে লাভবান হওয়া যাবে। সম্প্রচারক সংস্থাগুলি চায়, একদিনের ম্যাচ যেন পুরো ৫০ ওভার করেই খেলা হয়। দর্শকরাও শেষবল পর্যন্ত রুদ্ধশ্বাস জয়-পরাজয় নিষ্পত্তির জন্য উন্মুখ আগ্রহে অপেক্ষা করেন। এ সব কারনে একদিনের ক্রিকেটে পিচ হয়ে উঠছে টেলর-মেড, যা ব্যাটসম্যানদের সহায়ক। সেইসঙ্গে বাউন্ডারির দূরত্বও কমে গিয়েছে। এতে ব্যাটসম্যানদের পক্ষে চার-ছয় মারা অনেক সহজ হয়েছে। কিন্তু সচিনের সময় পিচ এতটা টেলর-মেড হত না। বাউন্ডারির দূরত্বও বেশি থাকত। ব্যাট ও বলের লড়াইয়ের উপযুক্ত পিচই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তৈরি করা হত। সেইসঙ্গে ব্যাটের আকারের কথাও বলতে হয়। এখন যে ব্যাট তৈরি হয়, তাতে শট খেলা অনেকটাই সহজ। এ সব সত্ত্বেও সমসাময়িকদের মধ্যে সচিনের স্ট্রাইক রেট ছিল অন্যতম সেরা। যে কোনও বোলারকে দুরমুশ করার ক্ষমতা ছিল তাঁর। ওই সময় এই দক্ষতা ছিল বিরল। কোহলি একই রকম দক্ষ। কিন্তু এখন আরও অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা এই কাজ করতে পারেন। আধুনিক টি ২০ ক্রিকেটে বড় শট একেবারেই বিরল নয়, বরং ওই শট খেলার ক্ষমতা থাকার প্রয়োজন। বোলার: সচিন তাঁর সময়ে ওয়াসিম আক্রম থেকে শুরু করে গ্লেন ম্যাক গ্র-র মতো বোলারদের খেলেছেন। বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা বোলারদের বিরুদ্ধে খেলে রান করতে হত সচিনকে। তাঁর খেলার সময় প্রায় প্রত্যেক দলেই সমীহ জাগানো পেস ও স্পিন অ্যাটাক থাকত। সচিন অ্যালান ডোনাল্ড, জেসন জিলেসপি, ওয়াকার ইউনিস, সাকলিন মুস্তাক, মুরলীধরন ও শোয়েব আখতারের মতো বোলারদের খেলেছেন। কিন্তু বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া সমীহ জাগানোর মতো বোলারের সংখ্যাটা একেবারেই কম। কিন্তু একইসঙ্গে বলতে হয়, সমসাময়িকদের তুলনায় স্কোরিংয়ের গতি অনেকটাই বেশি। যে কোনও পরিস্থিতিতে যে কোনও বোলিং আক্রমণ কোহলির ব্যাটের দাপটে গুটিয়ে যায়। এই ক্ষমতা কিন্তু স্টিভ স্মিথের নেই। ব্যাটিং লাইনআপ: ক্রিকেট কেরিয়ারের বেশিরভাগ সময়টাই ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ সচিনের ওপরই নির্ভরশীল ছিল। ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি খুব একটা খোলা মনে খেলার সুযোগ পাননি। বিপক্ষ শিবিরের লক্ষ্য ছিল সচিনকে আউট করা। আর তা করতে পারলেই অর্ধেক ম্যাচ জিতে নেওয়া যেত। তাই সর্বদাই বিপুল চাপ নিয়ে খেলতে হত তাঁকে। অন্যদিকে, কোহলি কেরিয়ারের শুরুতেই বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। বীরেন্দ্র সহবাগ, সচিন, রাহুল দ্রাবিড়, যুবরাজ সিংহ, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ও রোহিত শর্মার মতো ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে খেলার সুযোগ পাওয়ায় শুরুতে অনেকটাই খোলামনে ব্যাটিং করতে পারতেন তিনি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, পুরো দলের দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিতে পারেন না কোহলি। বরং তার উল্টোটাই। বহুক্ষেত্রেই একক দক্ষতায় ভারতকে জিতিয়েছেন কোহলি। এই সব বিশ্লেষণ থেকে একটা বিষয়ে সবাই একমত হতে পারেন যে, দুই প্রজন্মের দুই সেরা ব্যাটসম্যানের মধ্যে এভাবে তুলনা টানা যায় না। যেমন সচিনের সঙ্গে তুলনা করা যায় না সুনীল গাওস্করের। একটা বিষয়ে ভারতীয় হিসেবে গর্বিত হতে পারা যায় যে, ভারত এমন ব্যাটসম্যানদের জন্ম দিয়েছে, যাঁরা বারেবারেই খেলার সংজ্ঞাটাই পাল্টে দিয়েছেন এবং দেশের কোটি কোটি মানুষের আনন্দের উত্স হয়ে উঠেছেন।