কলকাতা: আসন্ন ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (ISL) শুধুই কি ডার্বির উত্তাপ ও উত্তেজনা ফিরে আসবে? না, তার সঙ্গে ফিরে আসবে দুই প্রধানের দুই স্প্যানিশ কোচের তুখোড় ফুটবল মস্তিষ্কের লড়াইও। তাই কলকাতা ডার্বি যতটা হয়ে উঠতে চলেছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট (Mohun Bagan Super Giant) বনাম ইস্টবেঙ্গল এফসি (East Bengal FC), ততটাই হয়ে উঠতে চলেছে হুয়ান ফেরান্দো বনাম কার্লস কুয়াদ্রাতও।
দুই কোচের সঙ্গে বার্সেলোনা শহর ও সেই শহরের বিখ্যাত ক্লাব বার্সেলোনা এফসি-র একটা গভীর সম্পর্ক আছে। দুজনেরই কোচ হিসেবে উঠে আসার পিছনে বার্সেলোনার অ্যাকাডেমির অবদান অনস্বীকার্য। শিকড় একই জায়গায় থাকলে কী হবে, দু’জনের ফুটবল দর্শন কিন্তু আলাদা। এবং খেলার স্টাইলও ভিন্ন।
ফেরান্দোর কাছে বল দখলে রাখা নিখুঁত টেকনিক বজায় রাখা যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ঘন ঘন আক্রমণে ওঠা, বিপক্ষের ফুল ব্যাকদের ব্যস্ত রাখা এবং খেলার ফল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা— এগুলোই তাঁর কাছে সাফল্যের মন্ত্র। সাম্প্রতিককালে মোহনবাগানের খেলাতেও তার ছাপ দেখতে পাওয়া যায়।
বার্সেলোনায় জন্ম ফেরান্দোর। এ রকম একটা জায়গায় বড় হয়ে উঠতে উঠতে বড় ফুটবলার হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভাগ্যবিধাতা বোধহয় তাঁর জন্য অন্য কিছু ঠিক করে রেখেছিলেন। কেরিয়ারের শুরুতেই পরপর চোট লাগার কারণে ফুটবলার হিসেবে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই কঠিন হয়ে ওঠে তাঁর পক্ষে। যখন তিনি বুঝেই যান যে ফুটবলার হয়ে মাঠে নামার স্বপ্ন পূরণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, তখন ফেরান্দো ঠিক করেন কোচ হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। ফুটবল মাঠে সারা জীবন কাটাতে হলে এটাই একমাত্র পথ। বার্সেলোনা ও মালাগার অ্যাকাডেমি তাঁর সেই ভাবনায় ইন্ধন জোগায়।
খেলোয়াড়জীবনে একের পর এক চোট পেয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ফুটবল মাঠে নামা ছেড়ে দিলেও ফুটবল ফেরান্দোকে ছাড়েনি। স্পেনের এস্পানিয়ল ক্লাব থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই যুবক প্রথমে সেই ক্লাবের ক্যাম্পাস অ্যান্ড মেথডলজিকাল কোচের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর হাতে-কলমে কোচিংয়ের শিক্ষা বার্সেলোনা ‘বি’ দলে। সেখান থেকেই স্পেনের প্রেমিয়া, তেরাসা, হসপিতালেত, মালাগা ক্লাবের যুব দলের কোচ। ২০১৩-য় মলদোভিয়া যাত্রা করেন শেরিফ তিরাসপল ক্লাবের ডাকে। ২০১৪-য় গ্রিসের এর্গোতেলিসে কোচিং করানোর পরে ফিরে আসেন নিজের দেশে, কালচারাল লিওনেসার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে। ২০১৭-য় লিনারেস ফুটবল ক্লাবের দায়িত্ব নেন। তার পরে পাঁচ বছর গ্রিসের ভোলোসে। সেখান থেকেই ২০২০-তে এফসি গোয়ায় এবং পরের মরশুমের মাঝখানে এটিকে মোহনবাগানে।
কুয়াদ্রাতের কোচ হওয়ার গল্পটা একটু অন্যরকম। তিনি এফসি বার্সেলোনার ফুটবল অ্যাকাডেমি থেকে সরাসরি উঠে আসা এক ফসল। ফেরান্দোর মতো তাঁরও জন্ম বার্সেলোনায়। সেখানকার জগদ্বিখ্যাত ক্লাবেরই অ্যাকাডেমির গ্র্যাজুয়েট। ভারতে আসার আগে বার্সেলোনার বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলের কোচের ভূমিকা পালন করেন তিনি।
সেখান থেকে যখন তিনি ভারতে এসে বেঙ্গালুরু এফসি-র কোচিং সিস্টেমে প্রবেশ করেন, তখনই হেড কোচ হওয়ার পথে পা বাড়ান। ২০১৬ থেকে ২০১৮—ভারতে তাঁর প্রথম পর্বে কুয়াদ্রাত বেঙ্গালুরু এফসি-র সহকারী কোচের পদে ছিলেন ও তাদের ফেডারেশন কাপ, প্রথম সুপার কাপ জিততে সাহায্য করেন। সেই সময়ে বেঙ্গালুরু এফসি প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে এএফসি কাপের ফাইনালে উঠেছিল।
এর পরে, ২০১৮-য় প্রধান কোচ হিসেবে বেঙ্গালুরু এফসি-র দায়িত্ব নেন তিনি। প্রথম মরশুমেই (২০১৮-১৯) দলকে প্রথম আইএসএল চ্যাম্পিয়ন করেন কুয়াদ্রাত। তাঁরই প্রশিক্ষণে বেঙ্গালুরু একই মরশুমে লিগসেরা ও ট্রফিজয়ী দুইই হয়। পরের বছর তাঁর প্রশিক্ষণে থাকা বেঙ্গালুরুর দল ফের প্লে-অফে ওঠে। অর্থাৎ, তিনি ভারতে কোচিং করতে এসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাফল্যই পেয়েছেন। শুধু সাফল্য নয়, বহু নজিরও গড়েছে তাঁর দল।
“যখন আমি বেঙ্গালুরুর দায়িত্ব পাই, তখন ইউরোপের কৌশলই এখানে আনতে চেয়েছিলাম। তার আগের মরশুমে আমরা বহু ম্যাচে কোনও গোল খাইনি। তখন মনে হল এই ব্যাপারটায় ধারাবাহিকতা আনতে হবে আমাকে। ইস্টবেঙ্গলে আমরা হাতে অনেকটা সময় পাচ্ছি। আমাদেরও এই পথে এগোতে হবে। নিজেদের গোলের সামনে দুর্ভেদ্য হয়ে উঠতে হবে। ফুটবলের অ্যাকশন একইরকম দেখতে লাগলেও এগুলোর পিছনে অনেক রকমের সুক্ষ্ম বুদ্ধি থাকে”, বলেন কুয়াদ্রাত।
বার্সেলোনার কিংবদন্তি তারকা জোহান ক্রুয়েফের প্রসঙ্গে টেনে এনে তিনি বলেন, “বার্সেলোনায় জোহান ক্রুয়েফ বলতেন, ‘আমরা জিততে চাই, সে ৬-৫-এ হলেও আমার আপত্তি নেই’। ওঁকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আমি আরও কিছুটা চালাক হতে চাই। আমি তিন পয়েন্টের জন্য যেতে চাই, কিন্তু বেশি ঝুঁকি নিতে চাই না”। অর্থাৎ ফেরান্দোর মতো শুরু থেকেই আক্রমণের নীতি নিয়ে যে খেলার পক্ষপাতী নন তিনি. তা বেশ ভালই বুঝিয়ে দিয়েছেন কুয়াদ্রাত। তাঁর বক্তব্য, গোল না খেয়ে, আগে ঘর পাকা সামলানোর ব্যবস্থা করার পর তার পরে আক্রমণে ওঠো।
মরশুমের প্রথম ডার্বিতে এই কৌশলেই বাজিমাত করেন কুয়াদ্রাত। নিজেদের ও বিপক্ষের শক্তি বুঝে নিয়ে তার পরে আক্রমণে ওঠো, এটাই ছিল মূল কৌশল। দুই উইং দিয়ে নন্দকুমার শেখর ওমহেশ সিংকে দিয়ে অপারেট করিয়ে সে দিন ক্রমশ আক্রমণে ধার বাড়ায় ইস্টবেঙ্গল। মোহনবাগানকে আক্রমণের জন্য কোনও জায়গায় তৈরি করতে না দেওয়ার পরিকল্পনা আগে থেকেই করা ছিল তাদের। নিজেদের গোল এরিয়ায় রক্ষণ জমাট করে সুযোগ বুঝে প্রতি আক্রমণে ওঠার প্রবণতাই দেখা যায় তাদের খেলায়। এই পরিকল্পনা সফল হতে তো সময় লাগবেই। সে জন্যই ম্যাচের একমাত্র গোলটি আসতে লেগে যায় ৬০ মিনিট।
অন্যদিকে, ফেরান্দো চেয়েছিলেন, আক্রমণের ধার বজায় রাখতে। তাই ৫৬ মিনিটের মাথায় ক্লান্ত হুগো বুমৌস ও আরমান্দো সাদিকুকে তুলে দিমিত্রিয়স পেট্রাটস ও জেসন কামিংসকে নামান তিনি। উদ্দেশ্য ছিল আক্রমণে ঝড় তোলার। কিন্তু তাঁরা যে মরশুমের প্রথম ডার্বি খেলছিলেন। তাই নিজেদের অতটা গুছিয়ে নিতে পারেননি। নন্দকুমার যখন গোল পান, তখন মোহনবাগানের প্রায় পুরো দলটাই কার্যত ছিল বিপক্ষের অর্ধে। ইস্টবেঙ্গল যে প্রতি আক্রমণে উঠতেই পারে, সে কথা বোধহয় তারা ভুলেই গিয়েছিলেন। এই আল্ট্রা হাইলাইন ফুটবলের প্রবণতাই মাঝে মাঝে ফেরান্দোকে সমস্যায় ফেলতে পারেন। কিন্তু কুয়াদ্রাতের ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ ফুটবল সেই ইংরাজি প্রবাদটার কথা মনে করিয়ে দেয়, ‘স্লো বাট স্টেডি উইন দ্য রেস’।
মরশুমের প্রথম ডার্বিতে এই ধাক্কাটাই ফেরান্দোকে অন্য ভাবে ভাবতে শুরু করায়। তাই ফাইনালে তিনি যখন ফের ইস্টবেঙ্গলের মুখোমুখি হন, তখন কয়েকটি বিষয়ে বেশি জোর দেন। দলের খেলোয়াড়দের মনে করিয়ে দেন, ট্রানজিশন অর্থাৎ রক্ষণ থেকে আক্রমণে ওঠে এবং আক্রমণের পর রক্ষণে নেমে আসা যথাসম্ভব দ্রত করতে হবে, নিজেদের ও বিপক্ষের গোলের সামনে মুভমেন্ট যথাসম্ভব খুঁতহীন ও গোছানো হতে হবে এবং দলের শেপ ঠিক রাখতে হবে। তিনি বরাবরই বলে এসেছেনে দলের খেলায় কয়েকটা খুঁটিনাটি ব্যাপারের ওপর নির্ভর করে সাফল্য ও ব্যর্থতা। ডুরান্ড ফাইনালে এই সবকটি বিষয়েই ইস্টবেঙ্গলকে পিছনে ফেলে দেয় মোহনবাগান এসজি।
দ্বিতীয় ডার্বিতে কিন্তু তাঁর দলকে সেই ভুল করতে দেখা যায়নি, যা তারা প্রথম ডার্বিতে করেছিল। অযথা ঝুঁকি নিয়ে আক্রমণে ওঠার বেশি প্রবণতা এই ম্যাচে কিন্তু দেখা যায়নি তাদের খেলায়। বরং মাঝমাঠ গোছানোর দিকে বেশি নজর দেন ফেরান্দো। যার ফলে আক্রমণেও বেশি তীব্রতা ছিল না। প্রথমার্ধে কোনও দলেরই একটিও শট গোলে ছিল না। কুয়াদ্রাত কিন্তু তাঁর পরিকল্পনাতেই টিকে ছিলেন। ধীরে চলো নীতি নিয়েই তিনি সে দিন খেলানোর চেষ্টা করেন দলকে। কিন্তু যেহেতু প্রতিপক্ষ সে দিন মাঝমাঠকে বেশ আঁটোসাঁটো করে রেখেছিল, তাই আক্রমণে বেশি উঠতে পারেননি।
অনেকেই নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, প্রথম ডার্বিতে যে ভুলের মাশুল দিতে হয়েছিল মোহনবাগানকে, পরের ডার্বিতে প্রায় একই ভুলের খেসারত দিতে হয় লাল-হলুদ শিবিরকে। সেই আক্রমণে ওঠার পরে দ্রুত রক্ষণে ফিরতে না পারার ভুল এ বার করতে দেখা যায় কুয়াদ্রাতের দলের খেলোয়াড়দেরও। এই ভুলকেই কাজে লাগিয়ে পেট্রাটস প্রতি আক্রমণ থেকে গোল করে চলে আসেন।
মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট এ বার এএফসি কাপ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে ইস্টবেঙ্গলের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করে দল গড়েছে। সেই দলে তারকাদের ভীড়। অনেকে যদিও ‘অতি সন্যাসিতে গাজন নষ্ট’ প্রবাদটির সঙ্গে এর মিল পাচ্ছেন। ফেরান্দোর খেলোয়াড় পরিবর্তন নীতি নিয়েও গত মরশুমে অনেক প্রশ্ন ওঠে। যে পরিস্থিতিতে যে খেলোয়াড়কে নামানোর দরকার, সেই পরিস্থিতিতে তাঁকে না নামিয়ে অনেক দেরিতে নামাচ্ছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ বারেও ফেরান্দোর সেই একই ‘সমস্যা’ থাকলে তারকায় ঠাসা দলের সমস্যা আরও বাড়তে পারে।
কুয়াদ্রাতের বিরুদ্ধে অবশ্য সেই অভিযোগ ওঠেনি কখনও। খেলোয়াড় পরিবর্তন নিয়ে বরং তিনি বরাবর এগিয়ে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অভ্যস্ত। বেঙ্গালুরুর কোচ থাকাকলীন অন্তত সেরকমই পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন তিনি। এ বারও মরশুমের শুরুতে তা দেখিয়েছেন তিনি। ফেরান্দোও অবশ্য তেমন কোনও ‘ভুল’ এখন পর্যন্ত করেননি বলেই মনে হচ্ছে। হয়তো গত মরশুমের ভুল বুঝতে পেরে এ মরশুমে নিজেকে শোধরাবেন তিনি। না হলে মহাতারকাদের সামলানো তাঁর পক্ষে মুশকিল হতে পারে। যদিও তাঁর সঙ্গে আন্তোনিও লোপেজ হাবাস থাকতে পারেন। তিনি এ বার টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে রয়েছেন মোহনবাগানে। এই ব্যাপারে তিনিও পরামর্শ দিতে পারেন ফেরান্দোকে। তবে দুই স্প্যানিশ মস্তিষ্কের লড়াই যে এ বার আইএসএলের বঙ্গ দ্বৈরথে এক অন্য মাত্রা এনে দিতে চলেছে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।