কলকাতা: পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে দু’গোলে পিছিয়ে থাকার পরও ৪-২ জয়ের পর উজ্জীবিত ইস্টবেঙ্গল শিবির (East Bengal FC) এখন আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফুটছে। মঙ্গলবার যেভাবে দ্বিতীয়ার্ধে যাবতীয় ভুল শুধরে নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিয়ে ফর্মে থাকা পাঞ্জাব এফসি-র হাত থেকে জয় ছিনিয়ে নেয় তারা, তার পরে তাদের দক্ষতা নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন উঠছে না।
লিগের শুরুটা অত্যন্ত খারাপ হওয়ার পরেও যে ভাবে ক্রমশ নিজেদের ফিরিয়ে আনছেন লাল-হলুদ শিবিরের ফুটবলাররা ও তাঁদের কোচ অস্কার ব্রুজো, তার পরে সমর্থকেরা তাদের প্রিয় দলকে সেরা ছয়ে দেখার অপেক্ষায় রয়েছে।
এই অসাধারণ জয়ের পরেও অবশ্য লিগ টেবলে ১১ নম্বরেই রয়ে গিয়েছে ইস্টবেঙ্গল। এই জায়গা থেকে তাদের আরও ওপরে উঠতে গেলে পরের দুই ম্যাচে জামশেদপুর এফসি ও হায়দরাবাদ এফসি-কে হারাতেই হবে। এই দুই ম্যাচে পুরো পয়েন্ট অর্জন করতে পারলে আরও কয়েক ধাপ ওপরে উঠতে পারবে তারা। তখন নতুন বছরে নতুন করে সেরা ছয়ে পৌঁছনোর লড়াইয়ে নামতে পারবে তারা। আপাতত সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যেতে চায় মশাল-বাহিনী।
মঙ্গলবার ম্যাচের পর ISL-এর ওয়েবসাইটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দলের মিডফিল্ডার শৌভিক চক্রবর্তী বলেন, "ইতিহাসে ইস্টবেঙ্গল বরাবরই লড়াকু দল বলে পরিচিত। আজ বিরতিতে ড্রেসিংরুমে ফিরে গিয়ে কোচ আমাদের প্রচণ্ডরকমের উদ্বুদ্ধ করেন, যাতে আমরা একশো শতাংশ দিই। কারণ, প্রথমার্ধে আমরা একশো শতাংশ দিতে পারিনি। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে আমরা নিজেদের উজাড় করে দিতে পেরেছি। দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজেদের একশো শতাংশ দিয়ে জার্সির সন্মান রাখতে পেরেছি আমরা। এখনও অনেক লড়াই বাকি আছে আমাদের। আমরা সবসময়ই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে আমরা সেরা ছয়ে পৌঁছতে পারব। এখনও আছি।"
আইএসএলের আসরে এ রকম জয় কখনও দেখেননি ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা। লিগের ইতিহাসে এই প্রথম দুই গোলে পিছিয়ে থাকার পরেও কোনও ম্যাচে জিতল ইস্টবেঙ্গল। এর আগে তারা ৩১টি ম্যাচে দু’গোলে পিছিয়ে পড়ার পর মাত্র একবার তা ড্র রাখতে পেরেছিল। বাকি ৩০বারই হেরে যায়। আরও বিস্তারিত ভাবে দেখলে এই প্রথম কলকাতার কোনও দল আইএসএলের কোনও ম্যাচে দ্বিতীয়ার্ধে চার গোল করল।
প্রথম দলের চার খেলোয়াড়কে ছাড়া খেলতে নামা ইস্টবেঙ্গলের এমন নাটকীয় জয় চলতি লিগের সেরা অঘটনগুলির তালিকায় অবশ্যই থাকবে। মঙ্গলবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ম্যাচের প্রথমার্ধে ৪০ মিনিটের মধ্যে হাঙ্গেরিয়ান ফরোয়ার্ড আসমির সুলজিক ও আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার নর্বের্তো ভিদালের গোলে এগিয়ে যায় পাঞ্জাব। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকে পিভি বিষ্ণু রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে নামার পরেই ইস্টবেঙ্গলের মেজাজ পুরো বদলে যায় এবং মাত্র ২১ মিনিটের মধ্যে চার-চারটি গোল করে জয় নিশ্চিত করে ফেলে তারা।
দ্বিতীয়ার্ধের দ্বিতীয় মিনিটেই সেটপিস গোল করে প্রথমে ব্যবধান কমান হিজাজি মাহের। এই গোলের আট মিনিট পরেই সমতা আনেন বিষ্ণু। ৬০ মিনিটের মাথায় পাঞ্জাবের ডিফেন্ডার সুরেশ মিতেইয়ের নিজ গোলে এগিয়ে যায় লাল-হলুদ বাহিনী, যে ব্যবধান ৬৭ মিনিটের মাথায় বাড়িয়ে নেন ইস্টবেঙ্গলের ফরোয়ার্ড ডেভিড লালনসাঙ্গা। এই প্রথম একই ম্যাচে একটি গোল ও একটি অ্যাসিস্ট করেন বিষ্ণু।
এই অভূতপূর্ব জয়ের পর দলের অধিনায়ক, ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড ক্লেটন সিলভা সাংবাদিকদের বলেন, "দ্বিতীয়ার্ধেই আমরা আসল খেলাটা খেলি। এটা ঠিকই যে বিষ্ণু দ্বিতীয়ার্ধে নামার পরেই আমাদের খেলায় অনেক পরিবর্তন আসে। গত কয়েকটা ম্যাচেও বিষ্ণু ভাল খেলেছে। দ্বিতীয়ার্ধে ওকে নামানোর প্রয়োজন ছিল আর দ্বিতীয়ার্ধের ৪৫ মিনিটই ওর নিজেকে প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট।"
কোচ অস্কার ব্রুজোনই প্রথম ইস্টবেঙ্গল কোচ, যিনি তাঁর প্রথম সাত ম্যাচে দলকে দশ পয়েন্ট এনে দিলেন। এর আগে কার্লস কুয়াদ্রাত তাঁর প্রথম সাত ম্যাচে আট পয়েন্ট এনে দিয়েছিলেন দলকে। এ বার তাঁকেও ছাড়িয়ে গেলেন অস্কার।
ম্যাচের পর সাংবাদিকদের বৈঠকে অবধারিত ভাবে প্রশ্ন ওঠে লাল-হলুদ কোচ অস্কার ব্রুজোন বিরতিতে এমন কী বলেছিলেন, যার পরে তাঁর দল রীতিমতো ঝড় তুলে দেয়? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "প্রথমার্ধে দলের খেলা দেখে আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম। কিছুই ঠিক হচ্ছিল না আমাদের। আমরা লড়াই করার জায়গায় ছিলাম না তখন। বিরতিতে ছেলেদের বলি, দ্বিতীয়ার্ধেও যদি এমনই বাজে পারফরম্যান্স চলতে থাকে, তা হলে আমাদের পক্ষে পুরো ৯০ মিনিটও দাঁড়ানো মুশকিল হবে। প্রথমার্ধে যা যা ঠিক হচ্ছিল না, বিরতির পর সেগুলোই ঠিক ঠিক হতে শুরু করে।"
বিরতিতে কী হয়েছিল, ক্লেটনের কাছে তা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, "বিরতিতে শুধু কোচ নন, দলের প্রত্যেকেই উপলব্ধি করে যে প্রথমার্ধে কী কী ভুল হয়েছে এবং দ্বিতীয়ার্ধে সেগুলো শোধরাতেই হবে। প্রথমার্ধে সত্যিই খারাপ খেলেছি আমরা। এমনকী, থ্রো-ইন থেকেও গোল খেয়েছি। মনসংযোগের অভাব হচ্ছিল তখন। দ্বিতীয়ার্ধে, সেগুলো শুধরে দুর্দান্ত খেলি আমরা।"
ক্লেটনের প্রশংসা করে কোচ অস্কার বলেন, "ও শুধু আক্রমণে সাহায্য করেনি, মাঝমাঠকে ধরে রাখতেও সাহায্য করেছে। যার ফলে দ্বিতীয়ার্ধে মাঝমাঠ আমাদেরই নিয়ন্ত্রণে ছিল। আর মাঝমাঠ যার নিয়ন্ত্রণে থাকে, ম্যাচে সেই দলই আধিপত্য বিস্তার করে। আমাদের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।"
নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে এ দিন গত দুই আইএসএলে ২০ গোল পাওয়া ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড বলেন, "লিগের শুরুর দিকে আমি বেশিক্ষণ মাঠে থাকতে পারিনি। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে আমার কাছে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ এসেছে। আমিও যে ৯০ মিনিট খেলে দলকে সাফল্য এনে দিতে পারি, তা প্রমাণ করার সুযোগ। সেই চেষ্টাই করছি।" এ বারের লিগে ১১টি ম্যাচে ৫৩১ মিনিট মাঠে থেকে একটি অ্যাসিস্ট করলেও কোনও গোল করতে পারেননি তিনি।
দল যে সেরা ছয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী, গোলকিপার প্রভসুখন গিলের কথায় সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। তিনি বলেন, "দলের মধ্যে এই স্পিরিট থাকলে সেরা ছয়ে পৌঁছনো অবশ্যই সম্ভব। ঘরের মাঠে আমাদের যে রকম খেলা উচিত, আজ দ্বিতীয়ার্ধে আমরা সে রকমই খেলেছি। খুবই উজ্জীবিত ফুটবল খেলেছি সবাই। এই জয় থেকে দল অনেক প্রেরণা পেয়েছে। এর পরে আরও ভাল খেলার চেষ্টা করতে হবে আমাদের।" (সৌ: আইএসএল মিডিয়া)
আরও পড়ুন: একা সৌরাশিস নয়, এক বল নাকানিচোবানি খাইয়েছিল কার্তিক, বালাজিকেও! অশ্বিনের কেরামতির গল্প
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।