কলকাতা: চলতি মরশুমে টানা আটটি ম্যাচে হারের পর ভুটানের পারো এফসি-র বিরুদ্ধে ২-২ ড্র করে ইস্টবেঙ্গল (East Bengal FC)। বাংলাদেশের বসুন্ধরা কিংসের বিরুদ্ধে তাদের চার গোলে জয় দেখে ইস্টবেঙ্গল সম্পর্কে অনেকে মন্তব্য করতে শুরু করে, যেন খোঁচা খাওয়া বাঘ ফের জেগে উঠেছে। পারোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফেরা ও বসুন্ধরার বিরুদ্ধে তাদের দাপুটে পারফরম্যান্সই ইস্টবেঙ্গল শিবিরে নতুন করে আত্মবিশ্বাসের বারুদ জমিয়ে তোলে, যাতে আগুনের ফুলকি এসে পড়ে শুক্রবার নেজমেহ এসসি-র বাবা আবদুলাই মুসার আত্মঘাতী গোলের পর। সেই আগুনেই শেষ পুড়তে হয় নেজমেহ-কে।


ভারতের সেরা লিগের একেবারে পিছনে থাকা ক্লাবের পক্ষে ফিফার ক্রমতালিকায় ভারতের চেয়ে দশ ধাপ ওপরে থাকা লেবাননের অন্যতম সেরা ক্লাবকে হারানোটা যে মোটেই সোজা কাজ নয়, তা যে কোনও ফুটবলপ্রেমী স্বীকার না করে পারবেন না। 


অনেকে পাল্টা যুক্তি দিতে পারেন, নেজমেহ-র দু’জন ছাড়া বিদেশি ফুটবলার নেই। তারা ইদানীং বেশি ম্যাচও খেলেনি। সেই সুযোগই কাজে লাগিয়েছে ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু প্রতিপক্ষের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে সফল হওয়াটা শুধু ফুটবল কেন, যে কোনও খেলারই নিয়ম। প্রতিপক্ষের দুর্বল জায়গাগুলো খুঁজে বের করাটা যেমন কৃতিত্বের, তেমনই সেই জায়গাগুলোতে আঘাত করতে পারাটাও অবশ্যই কৃতিত্বের। এর জন্যই একজন দক্ষ ও বুদ্ধিমান কোচের প্রয়োজন। অস্কার ব্রুজোন ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব নিয়ে সেই কাজটাই করতে পেরেছেন।


প্রথমে তিনি দলের ফুটবলারদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করেন। তাঁদের বোঝান, খারাপ সময় সবারই আসে, এতে ভেঙে পড়ার কিছু নেই, ঠাণ্ডা মাথায় পরিশ্রম করলে ও ধৈর্য্য ধরে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই চালিয়ে গেলে যে ভাবে রাতের পর দিন আসে, সে ভাবেই খারাপ সময়ের পর ভাল সময়ও আসে। তার পরে নিজেদের ভুলগুলো শোধরানোর উপায় বাতলে প্রতিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা অনুযায়ী নিজেদের রণনীতি তৈরি করেন অস্কার। বাকি কাজটুকু করেন দলের ফুটবলাররা। কোচের নির্দেশে যাঁদের মানসিক ও শারীরিক ভাবে তৈরি করে দেওয়া ছিল সাপোর্ট স্টাফের কাজ। ফুটবলে এটাই আসল টিমওয়ার্ক। সফল হওয়ার জন্য মাঠে তো বটেই, মাঠের বাইরেও ভাল টিমওয়ার্ক লাগে।


ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন কোচ কার্লেস কুয়াদ্রাত কেন এই কাজটা করতে পারেননি, তা এখন বিশ্লেষণ করে কোনও লাভ নেই। তিনি নিজেই অতীতকে ভুলে সামনের দিকে তাকানোর পক্ষপাতী। কম বেশি প্রত্যেক কোচই এই মানসিকতা নিয়েই চলেন। তাই এখন সামনের দিকেই তাকানো উচিত। এ বারের আইএসএলে তাদের ছ’টি ম্যাচ খেলা হয়ে গেলেও একটিও ম্যাচ জিততে বা ড্র-ও করতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল। এই লিগে এর চেয়ে খারাপ সূচনা এর আগে কখনও হয়নি তাদের। অন্য কোনও টুর্নামেন্টেও কখনও হয়েছে, এমন মনে করতে পারা বেশ কষ্টকর ব্যাপার।


মাত্র চারটি গোল করে ইতিমধ্যেই ১২টি গোল হজম করা হয়ে গিয়েছে তাদের। শুধু প্রথম ম্যাচ ছাড়া বাকি সব ম্যাচেই অন্তত দু’টি করে গোল খেয়েছে তারা। গত মরশুমে সুপার কাপ চ্যাম্পিয়নদের কাছ থেকে এমন পারফরম্যান্স সত্যিই অভাবনীয়। তার ওপর যখন এ বার তারা অনেক আগে থেকে প্রাক মরশুম প্রস্তুতি শুরু করেছে এবং গত বারের চেয়েও ভাল ভাল ফুটবলার দলে নিয়েছে, তখন এ বার এতটা খারাপ সূচনা একেবারেই প্রত্যাশিত ছিল না।


এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগ ও ইন্ডিয়ান সুপার লিগ যদিও এক রকম নয়, দুটো টুর্নামেন্টের চরিত্র আলাদা, নিয়ম-কানুনও আলাদা, বিশেষ করে প্রথম এগারোয় বিদেশীদের সংখ্যার নিয়ম। কিন্তু ফুটবলের অ-আ-ক-খ যে কোনও টুর্নামেন্টেই এক থাকে। নিজেদের ঘর সামলে প্রতিপক্ষের ঘরে হামলা করো, নিয়ন্ত্রণ যথাসম্ভব নিজেদের হাতে রাখো, দ্রুত ও সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে ওঠা-নামা (ট্রানজিশন) করো এবং একসঙ্গে আক্রমণে ওঠো। প্রতিপক্ষ পাল্টা আক্রমণে উঠলে দ্রুত রক্ষণে নেমে এসো ও নিজেদের দুর্গের সামনে লোকবল বাড়িয়ে তাদের আটকাও।


এখানেই শেষ নয়, প্রতিপক্ষের এলাকায় জায়গা তৈরি করে হানা দাও ও তাদের বক্সে ঢুকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে গোলে শট নাও বা হেড করো। যে টুর্নামেন্টই হোক না কেন, এর বাইরে আর কীই বা থাকতে পারে? ছোটখাটো, খুঁটিনাটি বিষয়গুলি, যেগুলোকে কোচেরা ‘স্মল ডিটেইলস’ বলে থাকেন, সেগুলো খেলা চলাকালীন প্রতিটি মুহূর্তে নিখুঁত ভাবে সাফল্যের সঙ্গে করা কোনও দলের পক্ষেই সম্ভব নয়। যে দল এগুলোতে কম ভুল করে, তারাই সাফল্যের মুখ দেখতে পায়। এর পরেও যে সব ম্যাচে একেবারে সঠিক ফল হয়, তাও নয়। অনেক ম্যাচেই দেখা যায় সব কিছু ভাল করেও কোনও দল তাদের প্রত্যাশিত ফল পায়নি। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের ক্ষেত্রে তেমন বলা যায় না। তারা আইএসএলে আজ পর্যন্ত যা যা দিতে পেরেছে, তেমনই ফল পেয়েছে। তাদের পারফরম্যান্সের প্রতিফলন তাদের প্রতি ম্যাচেই পাওয়া গিয়েছে।


ভুটানেও তার অন্যথা হয়নি। শুক্রবার সন্ধ্যায় এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার পর পর অস্কার বলেন, "আইএসএলে আমরা ভাল অবস্থায় নেই। তাই এই সাফল্য আমাদের ঘরোয়া লিগে ভাল খেলার প্রেরণা জোগাবে। এই স্তরের ফুটবলে সফল হতে গেলে যে রকম পারফরম্যান্স দিতে হয়, আমাদের ছেলেরা সে রকমই খেলেছে। টানা ৯০ মিনিট লড়াই করেছে। এই সাফল্যের জন্য দলের ছেলেদের ধন্যবাদ। তারা অনেক পরিশ্রম করেছে।" বাকিটুকু নিশ্চয়ই দলের ছেলেদের বলেছেন, এখনও অনেক লড়াই বাকি। সেই লড়াই অনেক দীর্ঘ ও কঠিন।


মার্চের প্রথম সপ্তাহে এএফসি-র কোয়ার্টার ফাইনাল পর্ব। যেখানে তাদের নিজেদের ঘরের মাঠ ও প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়েও খেলতে হবে। ওই সময়ে আইএসএলে লিগ পর্বে শেষ দু’টি রাউন্ড চলবে। তার আগে টানা আইএসএলের ম্যাচ খেলতে হবে অস্কারের দলের ফুটবলারদের। তখন দল কী অবস্থায় থাকবে, কেউ জানে না। ক্লান্তি যেমন ঘিরে ধরতে পারে তাদের, তেমনই আরও উন্নত ফুটবল খেলে আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফুটতেও পারে গোটা দল। তাই তাদের নজর এখন শুধুমাত্র আইএসএলে। কোচও সে কথাই বলেছেন।


তাঁর মতে, "এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগে এই সাফল্য আমাদের যে আত্মবিশ্বাস ও প্রেরণা জোগাল, তা আইএসএলের পরবর্তী ম্যাচে আমাদের নিশ্চয়ই কাজে লাগবে। আশা করি, আইএসএলের পরবর্তী ম্যাচেই আমরা এই পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারব। আমাদের কী পরিস্থিতি, তা সকলেরই জানা। তাই সময় নষ্ট না করে পরের ম্যাচ থেকেই নিজেদের সেরাটা দিতে হবে।"


দলের ফুটবলাররা যে তাদের সমস্যা ও তার সমাধান উপলব্ধি করতে পেরেছে, এটাই অস্কারের কাছে আনন্দের খবর। তিনি বলেন, "আইএসএলে আমরা সমস্যার মধ্যে আছিট ঠিকই, তবে ছেলেরা বুঝেছে যে, আমাদের লড়াই করার সময় এসে গিয়েছে। এশীয় স্তরের ম্যাচে কী ভাবে খেলতে হয়, তাও ওরা বুঝেছে। ৯০ মিনিট ধরে নিখুঁত খেলে যাওয়া সম্ভব নয় ঠিকই। কিন্তু কী ভাবে খেলায় ফিরব, তা বোঝা খুবই জরুরি। যখন প্রয়োজন, তখন নিজেদের সেরাটা দেওয়া প্রয়োজন। নেজমেহ-র বিরুদ্ধে ম্যাচের শুরুতেই দু’গোলে এগিয়ে গিয়ে আমরা সেটাই প্রমাণ করেছি। ওরা দু’গোল শোধ করে দ্বিতীয়ার্ধে আমাদের সমস্যায় ফেলে দিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু শেষ কুড়ি মিনিটে আমরা অবস্থা সামলে নিতে পেরেছি।"


এ ভাবেই যদি আইএসএলের পরের ম্যাচগুলি খেলতে পারে, এই লড়াই যদি জারি রাখতে পারে তারা, তা হলে ১৩ নম্বর থেকে সেরা ছয়ে উঠে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব। আপাতত তাদের পরবর্তী ম্যাচ আগামী শনিবার, তাদের অন্যতম চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মহমেডান এসসি-র বিরুদ্ধে। মহমেডান ভাল শুরু করেও অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছে, যা তাদের বেশ ধাক্কা দিয়েছে। সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠে ডার্বি জয়ের মরিয়া চেষ্টা করবেই সাদা-কালো ব্রিগেডও। ফলে একটা হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ হবে, ধরে নিয়েই সেই ম্যাচে মাঠে নামতে হবে অস্কারের দলকে।


তার পরে নিজেদের গুছিয়ে নিতে অনেকটা সময় পাবে তারা। কারণ, এই ম্যাচের কুড়ি দিন পর, ২৯ নভেম্বর, তারা ফের মাঠে নামবে নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে। এই সময়ে দুটো ঘটনা ঘটতে পারে। হয় দলের মধ্যে সদ্য আসা ইতিবাচক ছন্দটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অথবা, যাবতীয় সমস্যাগুলোর সমাধান করে দলকে আরও ভাল করে গুছিয়ে নিতে পারেন নতুন কোচ। দ্বিতীয়টাই হবে, এমনই আশা করা যায়। কারণ, অস্কার ও তাঁর দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে যে ক্রমশ একটা ইতিবাচক বোঝাপড়া গড়ে উঠছে, তা তাদের খেলা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এই বোঝাপড়াটা যত সময় এগোবে, ততই নিশ্চয়ই আরও শক্তপোক্ত হয়ে উঠবে এবং ততই দলের পারফরম্যান্সে নিশ্চয়ই উন্নতি আসবে।


আরও পড়ুন: ব্যাট-প্যাড কেনার টাকা ছিল না বলে হয়ে গেলেন পেসার! অবাক করবে কেকেআর তরুণের কাহিনি


এই কুড়ি দিনের অবকাশে তাদের সামনে এক কঠিন সময়ের জন্য তৈরি হওয়ার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে লাল-হলুদ বাহিনীকে। কারণ, অবকাশের পরে এক মাসে তাদের পরপর ছ’টি ম্যাচ খেলতে হবে, যা এই স্তরের ফুটবলে মোটেই সহজ নয়। তাও আবার পাঞ্জাব এফসি, ওডিশা এফসি, জামশেদপুর এফসি-র মতো ফর্মে থাকা দলগুলির বিরুদ্ধে।


অস্কার বলেছেন, "মাত্র চারটি অনুশীলনের সেশন করার সুযোগ পেয়েছি আমি। এই অল্প সময়ে প্রচুর ভিডিও বিশ্লেষণ করেছি। সবচেয়ে ইতিবাচক ব্যাপার হল দলের ফুটবলারদের নতুন চিন্তাধারা গ্রহণ করার মানসিকতা রয়েছে। এটাই সবচেয়ে ভাল ব্যাপার।" ফুটবলারদের এই মানসিকতা কাজে লাগিয়ে যে তিনি এত অল্প সময়ে দলকে আলোয় ফেরাতে পারেন, তার প্রমাণ ভুটানেই দিয়ে এসেছেন। এ বার দেশে ফিরেও সেই প্রমাণ দেওয়ার চ্যালেঞ্জ তাঁর সামনে। লাল-হলুদ বাহিনীর ফুটবলারদেরও প্রমাণ করতে হবে ভুটানের সাফল্য ফ্লুকে আসেনি, এটাই তাদের আসল খেলা। নিজেদের দেশের মাঠেও প্রমাণ করাই এখন তাদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। (সৌ: আইএসএল মিডিয়া)


আরও পড়ুন: ১৯ বছর বয়সে প্রথম সুযোগ, ৩১ ছুঁতে চললেন, বরাবরই স্পেশ্যাল হতে চেয়েছিলেন বুম বুম বুমরা




আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।