কলকাতা: গত মরশুমে আইএসএল (ISL) প্লে অফের দোরগোড়ায় গিয়েও অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। তবে সুপার কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল লাল-হলুদ শিবির। এবার আইএসএলে কীরকম সম্ভাবনা ইস্টবেঙ্গলের? কেমন হয়েছে দল? 


আগের তিন ISL-এ নবম স্থানে থেকে লিগ শেষ করে ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু এক সময় সেরা ছয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল লাল-হলুদ বাহিনী। কিন্তু শেষ ম্যাচে পাঞ্জাব এফসি-র কাছে কার্যত আত্মসমর্পণ করায় সেখানে পৌঁছেও ফিরে আসতে হয় তাদের। লিগ টেবলের ১১ নম্বরে নেমে যাওয়া পাঞ্জাব এফসি তাদের অনায়াসে ৪-১-এ হারিয়ে লিগ শেষ করে আট নম্বরে থেকে। 


গতবার একটা সময়ে টানা চারটি ম্যাচে ক্লিন শিট বজায় রেখেছিল ইস্টবেঙ্গল। নভেম্বরে কেরল ব্লাস্টার্সের কাছে হারের পর থেকে টানা ন'টি ম্যাচে অপরাজিত ছিল লাল-হলুদ শিবির। এর মধ্যে চারটি ম্যাচে ড্র ও পাঁচটিতে জিতেছিল তারা। সুপার কাপে চারটি ম্যাচে জেতে তারা। এমন ধারাবাহিকতা বহুদিন দেখা যায়নি ইস্টবেঙ্গলের খেলায়।


এ বার লাল-হলুদ বাহিনী প্রাক মরশুম প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিল জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে। মরশুম শুরুর আগে এক ঝাঁক নতুন ফুটবলারকে সই করায় কার্লেস কুয়াদ্রাতের দল। পাঞ্জাব এফসি থেকে ফরাসি অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার মাদি তালাল ও গত আইএসএলে গোল্ডেন বুটজয়ী গ্রিক ফরওয়ার্ড দিমিত্রি দিয়ামান্তাকসকে কেরল ব্লাস্টার্স এফসি থেকে নিয়ে আসে তারা। জর্ডনিয়ান ডিফেন্ডার হিজাজি মাহের, ব্রাজিলীয় ফরওয়ার্ড ক্লেটন সিলভা ও স্প্যানিশ মিডফিল্ডার সল ক্রেসপোর চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে তারা। মহমেডান এসসি থেকে তরুণ ফরওয়ার্ড ডেভিড লালনসাঙ্গা লাল-হলুদ বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। অর্থাৎ, আক্রমণ বিভাগকে বেশ শক্তিশালী করে তুলেছেন কুয়াদ্রাত, যাতে তাঁর দল অনেক গোল করতে পারে। রক্ষণ গতবারও খুব একটা খারাপ ছিল না, এ বারও হিজাজির সঙ্গে যোগ দিয়েছেন গতবার মোহনবাগানের হয়ে খেলা হেক্টর ইউস্তে। এ ছাড়া এক ঝাঁক প্রতিভাবান ভারতীয় ডিফেন্ডারও আছেন দলে। মাঝমাঠে তালাল ও ক্রেসপো যথেষ্ট কার্যকরী। তাঁদের সাহায্য করতে রয়েছেন নন্দকুমার, মহেশ, জিকসনদের মতো ভারতীয় মিডফিল্ডাররা। ফলে দলের মধ্যে এ বার গতবারের তুলনায় আরও ভারসাম্য আসবে বলেই মনে হয়। 


মরশুমের শুরুটা অবশ্য তেমন ভাল হয়নি ইস্টবেঙ্গলে। ডুরান্ড কাপে তারা পর্বে দুই ম্যাচে ছ'গোল করে শেষ আটে উঠলেও শিলং লাজং এফসি-র কাছে হেরে ছিটকে যায়। গ্রুপ পর্বে যতটা ভাল খেলেছিল তারা, নক আউটে সেই তুলনায় ভাল খেলতে পারেননি ক্লেটন সিলভারা। তবে এই টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্সে আইএসএলে ভাল খেলার ইঙ্গিত অবশ্যই ছিল।    


দলে নতুন মুখ


হেক্টর ইউস্তে, জিকসন সিংহ, দেবজিৎ মজুমদার, প্রভাক লাকড়া, নিশু কুমার, মাদি তালাল, মার্ক জোথানপুইয়া, ডেভিড লালনসাঙ্গা, দিমিত্রি দিয়ামান্তাকস। 


ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যাঁদের


সার্থক গলুই, কমলজিৎ সিংহ, মোবাশির রহমান, মন্দার রাও দেশাই, ফেলিসিও ফোর্বস, ভিক্টর ভাজকেজ, আলেকজান্দার প্যানটিচ, অজয় ছেত্রী। 


চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হল যাঁদের 


মহম্মদ রকিপ, হিজাজি মাহের, ক্লেটন সিলভা, সল ক্রেসপো। 


ম্যাচের মোড় ঘোরাতে পারেন যাঁরা


মাদি তালাল 


গত মরশুমে পাঞ্জাব এফসি-র হয়ে খেলে ছ’টি গোল করেছিলেন ও দশটি গোলে অ্যাসিস্ট করেছিলেন ফরাসি মিডফিল্ডার মাদি তালাল। ২৬ বছর বয়সী এই প্লেমেকার মরশুমের শুরুতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন লাল-হলুদ বাহিনীতে কতটা কার্যকরী হয়ে উঠতে চলেছেন তিনি। ভারতে আসার পর তালাল পাঞ্জাব এফসি-র হয়ে আইএসএলে ২২টি ও কলিঙ্গ সুপার কাপে তিনটি ম্যাচ খেলেন। গত আইএসএলে পাঞ্জাবের দল যে ছ’টি জয় পায়, তার মধ্যে পাঁচটিতেই হয় গোল, নয় অ্যাসিস্ট করেন তালাল। দুর্দান্ত বল নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিকারী ও তৎপর এই আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার গত আইএসএলে ৪২টি সফল ড্রিবল করেন, যা গত মরশুমে তাঁর নজিরগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল। গত মরশুমে সবচেয়ে বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করা খেলোয়াড়দের তালিকায় তিনি ছিলেন দু’নম্বরে। এ বছর ডুরান্ড কাপে তিনি তিনটি ম্যাচেই প্রায় পুরো সময়ই খেলেন। প্রথম ম্যাচে একটি গোলে অ্যাসিস্ট করেন ও দ্বিতীয় ম্যাচে নিজেই একটি গোল করেন। তিনি যোগ দেওয়ায় ইস্টবেঙ্গলের মাঝমাঠ আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে বলেই মনে হচ্ছে। এখন সারা মরশুম কতটা চোটমুক্ত হয়ে খেলতে পারেন তালাল, সেটাই দেখার। 


দিমিত্রি দিয়ামান্তাকস 


এতদিন তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরে একজন নায়ক ছিল, যাঁকে সমর্থকেরা আদর করে ডাকতেন ‘দিমি’ বলে। এ বার ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরাও তাঁদের ‘দিমি’-কে পেয়ে গিয়েছেন। ইনি গত আইএসএলের গোল্ডেন বুটজয়ী তারকা ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস। গত মরশুমে যিনি কেরালা ব্লাস্টার্সের পক্ষে ১৩টি গোল করে সবচেয়ে বেশি গোলদাতার সন্মান অর্জন করে নেন। দু’বছরের জন্য ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন এই গ্রিক ফরোয়ার্ড। গ্রিসের জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন এই সফল ফরোয়ার্ড। ২০১২-য় উয়েফা ইউরোপিয়ান অনূর্ধ্ব ১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্স আপ গ্রিক দলেরও সদস্য ছিলেন তিনি। কেরালা ব্লাস্টার্সে যোগ দেন ২০২২-এ এবং গত দুই মরশুমে ৩৮টি ম্যাচে ২৩টি গোল করেছেন দিয়ামান্তাকস। ছ’টি গোলে অ্যাসিস্টও করেছেন। আইএসএলে তাঁর প্রথম মরশুমেই দশটি গোল করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, লিগের তারকা হয়ে উঠতে চলেছেন তিনি । মাঠে তাঁর ক্যারিশমা তো সারা দেশ দেখেছে। কিন্তু মাঠের বাইরে, ড্রেসিংরুমে দলনেতা ও রোল মডেল হয়ে ওঠার যে দক্ষতা রয়েছে দিয়ামান্তাকসের, তাও প্রশংসনীয়। ডুরান্ড কাপে প্রথম ম্যাচে একটি গোল করেন ও একটিতে অ্যাসিস্ট করেন তিনি। 


গুরু কুয়াদ্রাত 


গত দু’বছরে ইসস্টবেঙ্গলকে অনেক পাল্টে দিয়েছেন তাদের স্প্যানিশ কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত। গত বছর সুপার কাপ চ্যাম্পিয়ন হয় তারা, যা ১২ বছর পর তাদের জেতা কোনও জাতীয় স্তরের খেতাব। যার  ফলে তারা এ মরশুমে এশীয় স্তরের টুর্নামেন্টেও খেলার সুযোগ পেয়েছে। তাঁর আমলে ইস্টবেঙ্গলের আইএসএল পরিসংখ্যানেও অনেক উন্নতি হয়েছে। গত মরশুমে তারা প্লে অফের দোরগোড়ায় এসেও ফিরে যায়। এ বার দলের আরও উন্নত পারফরম্যান্সের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী কুয়াদ্রাত। ভারতে কোচিং করানোর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে ৫৬ বছর বয়সী কুয়াদ্রাতের। ২০১৬ থেকে ২০১৮— ভারতে তাঁর প্রথম পর্বে কুয়াদ্রাত বেঙ্গালুরু এফসি-র সহকারী কোচের পদে ছিলেন ও তাদের ফেডারেশন কাপ, সুপার কাপ জিততে সাহায্য করেন। সেই সময়ে বেঙ্গালুরু এফসি প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে এএফসি কাপের ফাইনালে উঠেছিল। ২০১৮-য় প্রধান কোচ হিসেবে বেঙ্গালুরু এফসি-র দায়িত্ব নেন তিনি। প্রথম মরশুমেই (২০১৮-১৯) দলকে আইএসএল চ্যাম্পিয়ন করেন কুয়াদ্রাত। তাঁরই প্রশিক্ষণে বেঙ্গালুরু একই মরশুমে শিল্ড ও কাপ দুইই জেতে। পরের বছর তাঁর প্রশিক্ষণে থাকা বেঙ্গালুরুর দল ফের প্লে-অফে ওঠে। অর্থাৎ, তিনি ভারতে কোচিং করতে এসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাফল্যই পেয়েছেন। শুধু সাফল্য নয়, বহু নজিরও গড়েছে তাঁর দল। ভারত ছাড়াও তিনি সাইপ্রাস ও ডেনমার্কের দুই ক্লাবে সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করেন। (তথ্যসূত্র - ISL মিডিয়া)


আরও পড়ুন: বুড়ো হাড়ে ভেল্কি, রোনাল্ডোর গোলেই পিছিয়ে থেকেও জয় পর্তুগালের